জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কয়েক মাসের মারাত্মক রেকর্ড বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে শুক্রবার পাকিস্তান সফরে গিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসে। এসময় খোলা তাবুতে আশ্রয় নেয়া পাঁচ লাখ মানুষের মানবেতর জীবনযাপন দেখেন তিনি। এরপর দেশটিকে সাহায্য করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি এই আহ্বান জানান গুতেরেসে।
বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য গুতেরেস জরুরি তহবিলের জন্য ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আবেদন করার দুই সপ্তাহেরও কম সময় পরে তিনি সফরটি করলেন। এই বন্যার ফলে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে মারা গেছেন কমপক্ষে এক হাজার ৩৯১ জন মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ত্রাণবাহী বিমানসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে শুরু করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তিনি ভোরে এক টুইটে বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যার পর পাকিস্তানি জনগণের প্রতি গভীর সংহতি প্রকাশ করতে আমি পাকিস্তানে এসেছি। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্যাপক সহযোগিতার আহ্বান করছি, কারণ পাকিস্তান এই জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার।
জাতিসংঘের প্রধান গত সপ্তাহে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা জারি করেছেন।
তিনি সে সময় ইসলামাবাদে একটি অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, ‘আসুন জলবায়ু পরিবর্তনের ঘুমন্তগতির মাধ্যমে আমাদের গ্রহকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া বন্ধ করি। আজ পাকিস্তান, আগামীকাল আপনার দেশ এর শিকার হতে পারে।’
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের প্রধানকে এমন সময়ে পাকিস্তান সফরের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন যখন তিনি বলেন, পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে। তিনি বলেন, বন্যা দুর্গতদের সংকটকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পৌঁছাতে তিনি এই সফর চান।
‘জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবের পরিণতি উপলব্ধি করতেও এই সফর সাহায্য করবে।’ বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি৷
আওরঙ্গজেব বলেন, গুতেরেসে শুক্রবার ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেয়ার আগে বন্যার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা একটি ব্রিফিং করবেন।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে বন্যায় মৃতের সংখ্যা ১২শ’ ছাড়িয়েছে
এখন পর্যন্ত, জাতিসংঘের সংস্থা এবং বেশ কয়েকটি দেশ প্রায় ৬০টি ত্রাণবাহী বিমান করে সাহায্য পাঠিয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ বলছে সহায়তাদানকারীদের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন। কারণ তারা এখন পর্যন্ত ২৬টি ফ্লাইট পাঠিয়েছে যেগুলি সাহায্য বা বন্যার্তদের বহন করে।
বন্যা সমগ্র পাকিস্তানকে ছুঁয়েছে এবং ৩৩ লাখেরও বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। হেরিটেজ সাইটগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মহেঞ্জো দারো, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা-সংরক্ষিত প্রাচীন শহুরে জনবসতি হিসেবে বিবেচিত।
সিন্ধু নদীর কাছে ১৯২২ সালে একটি ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং আজ পর্যন্ত, প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে মিলে যাওয়া সাড়ে চার হাজার বছর আগের সভ্যতার অন্তর্ধানকে তুলে ধরছে।
মহেঞ্জো দারো একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং জাতিসংঘের ঐতিহ্য সংস্থা বৃহস্পতিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য তিন লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার জরুরি সহায়তা ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তান সফরকালে গুতেরেসকে অভ্যর্থনা জানান উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার। এই সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এবং অন্যান্য সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কারণ
জাতিসংঘ মহাসচিব পাকিস্তানে আগমনের আগে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ সফররত এক আমেরিকান কূটনীতিককে বলেছিলেন যে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক বন্যা এড়াতে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত। স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেরেক চোলেট ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং সাহায্যের ব্যবস্থা করতে ইসলামাবাদ সফর করছেন।
সরকারের বিবৃতিতে চোলেট নিশ্চিত করেছেন যে বন্যার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জনগণের পুনর্গঠনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলছেন, শুক্রবার প্রথম আমেরিকান বিমানভর্তি ত্রাণ পাকিস্তানে পৌঁছাবে, ওয়াশিংটন বন্যা দুর্গতদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা ও আকাশ পথে দুর্গতদের সঙ্গে একটি মানবিক সহায়তা সংযোগ স্থাপন করবে।
জুন মাস থেকে ভারী বর্ষণ এবং বন্যা নগদ অর্থ সংকটে পড়া পাকিস্তানে নতুন বোঝা চাপিয়েছে এবং দরিদ্র জনসংখ্যার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব তুলে ধরেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশের জন্য পাকিস্তান দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে ২১ শতাংশ, চীন ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইইউ ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির দেয়া তথ্যানুসারে দেশটিতে বন্যায় ১২ হাজার ৭২২ জন আহত হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা, ভেঙে পড়েছে সেতু এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য স্কুল ও হাসপাতাল।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে বন্যা: ৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত