কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী চলাচলে নিয়ন্ত্রণ এবং ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিপর্যয়,সংঘাত এবং সহিংসতার কারণে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম )‘বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন ২০২২’- এ তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার বিকেলে অভিবাসন বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে জাতিসংঘের এ সংস্থাটি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আইওএম । প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।কেননকা সংস্থাটির তথ্যমতে, অভিবাসী প্রেরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে গেল দুই বছরে বিশ্বব্যাপী অভিবাসন খাতের আদ্যপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয় বিশ্লেষণে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে অভিবাসনের ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক কারণগুলো। প্রতিবেদন অনুযায়ী,বিশ্বে ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ২৮১ মিলিয়ন বা ২৮ কোটি ১০ লাখ। অভিবাসী প্রেরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬ষ্ঠ এবং রেমিট্যান্স গ্রহনে ৮ম।
আরও পড়ুন: আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস
প্রতিবেদন সম্পর্কে আইওএম’র মহাপরিচালক অ্যান্টোনিও ভিটোরিনো বলেন, “আমরা একটি বৈপরীত্য লক্ষ্য করছি, যা মানব ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। কোভিড ১৯ এর কারণে শত কোটি মানুষ আটকা পড়েছে। তার পরেও লাখ লাখ বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ গৃহহীন হতে বাধ্য হয়েছেন।”
প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বব্যাপী আকাশপথে যাত্রী সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে যাত্রী সংখ্যা ছিল চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন যা ২০২০ সালে এক দশমিক আট বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে দুর্যোগ, সংঘাত ও সহিংসতার ফলে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন, যা এক বছর আগে ছিলো ৩১ দশমিক পাঁচ মিলিয়ন।
প্রতিবেদনটির সম্পাদক ম্যারি ম্যাকঅলিফ বলেছেন,“বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন সিরিজের ১১তম সংস্করণটিতে অভিবাসন বিষয়ে সম্প্রতিক তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে অভিবাসন প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে অভিবাসন নীতির নতুন নতুন দিক।”
আরও পড়ুন: কয়েক লাখ অভিবাসীকে নাগরিকত্বের মর্যাদা দিতে যাচ্ছেন বাইডেন
প্রতিবেদন অনুসারে, আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা ১৯৭০ সালে বিশ্বব্যাপী ৮৪ মিলিয়ন থেকে ২০২০ সালে ২৮১ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ মানুষই (৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ) যে দেশে জন্মগ্রহন করে সে দেশেই বসবাস করে। কোভিড-১৯ এর কারণে ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা দুই মিলিয়নের মতো কম ছিলো।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী বসবাস করা বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ছিল সাত দশমিক ৪০ মিলিয়ন। বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করেও প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ২০১৯ সালে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি দেশে পাঠিয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে এসেছে যারা গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) দেশগুলোতে প্রধানত ‘নিম্ন-দক্ষ’ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এই রেমিট্যান্সগুলো, যা জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক আয়ের উৎস।
প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোয় উদ্বুব্ধ করার জন্য নীতিনির্ধারকদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে নগদ প্রণোদনা স্কিমের সর্বোচ্চ সীমা তিনগুণেরও বেশি বাড়িয়েছে – যার ফলে রেমিট্যান্স সুবিধাভোগীরা আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে টাকা পাঠানোর উপর দুই শতাংশ বোনাস পান পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত। এছাড়া, রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ আরও বাড়াতে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক অতিরিক্ত এক শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করেছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রশংসায় সৌদি কর্তৃপক্ষ
আইওএম বাংলাদেশ-এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকমর্তা ফাতিমা নুসরাত গাজ্জালি বলেন,“রেমিট্যান্সের প্রবাহের ওপর কোভিড-১৯ অতিমারির নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও ২০২০ সালে ২১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। অভিবাসন বাংলাদেশের উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। অভিবাসীরা গন্তব্যদেশে উন্নত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য অভিবাসন করে এবং তারপরে নিজ দেশে জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সহায়তা করে।”
বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদনটি ডিজিটাল উপায়ে পড়া ও দেখার জন্য একটি অনলাইন প্লাটফর্ম রয়েছে। এ বছরের শুরুতে প্রতিবেদনটির ২০২০ সালের সংস্করণটি ‘আন্তর্জাতিক বার্ষিক প্রতিবেদন পুরষ্কার ২০২১’ এ সোনা জয় করেছে।
২০২২ সংস্করণে এখন একটি নতুন এবং সাধারণ ফ্যাক্ট-চেকারদের টুলকিট রয়েছে যা মাইগ্রেশনের মূল মিথগুলিকে আরও ভালভাবে বুঝতে সহায়তা করে। তথ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি, প্রতিবেদনে সেইসব পাঠকদের জন্য নির্দিষ্ট বিষয়গুলো আওতাভুক্ত করে যাদের আরও গভীরতর বিষয়বস্তুর প্রয়োজন। বিষয়গুলো হলো- স্থানান্তর এবং জলবায়ূ পরিবর্তন; অভিবাসনের সাথে শান্তি ও উন্নয়নের যোগসূত্র; অভিবাসন পথে মানব পাচার; কোভিড-১৯ এর প্রভাব; মাইগ্রেশন সম্পর্কে বিভ্রান্তি; ভুল তথ্যের যুগে অভিবাসীদের অবদান; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং স্থানান্তর, যা বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ দর্শকশ্রোতা উভয়ের জন্য সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।