প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা দর্শনীয় স্থানগুলোতে নান্দনিকতার পাশাপাশি থাকে মৌলিকতার ছোঁয়া। তার অকৃত্রিমতা অপরিবর্তিত রেখে কিছু মানবসৃষ্ট অবকাঠামোর সংযোজন জায়গাটির সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। খাগড়াছড়ির মায়ুং কপাল, হাতিমুড়া, বা হাতি মাথা ঠিক এমনি একটি জায়গা, যার প্রাচীনতায় লেশমাত্র দাগ ফেলেনি মনুষ্য সৃষ্টকর্ম। উল্টো প্রকৃতির এই অপার বিস্ময়কে সাজিয়ে তুলেছে শৈল্পিক অলঙ্করণে। অদ্ভূত আকৃতির এই পাহাড় নিয়েই এবারের ভ্রমণকথা।
এমন মজার নামের রহস্য উদ্ঘাটনের পাশাপাশি চলুন জেনে নেয়া যাক- কোন কোন বিষয়গুলো জায়গাটির প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
হাতিমুড়া বা মায়ুং কপালের অবস্থান ও বিশেষত্ব
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্রগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দুর্গম পাহাড় ঘেরা অন্যতম ইউনিয়ন পেরাছড়া। এই ইউনিয়নেরই সবচেয়ে দর্শনীয় পাহাড়টির নাম হাতি মাথা বা মায়ুং কপাল। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০৮ ফুট উচু এই পাহাড় নানা জনগোষ্ঠীর মোট ১৫টি গ্রামকে সযত্নে আগলে রেখেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলার সীমান্তবর্তী ভাঙ্গামুড়া, মাখন তাইসা পাড়া, বদলছড়া, হাজা পাড়া, কিনাপা পাড়া, কাপ্তালপাড়া, বাগড়া পাড়া, সাধুপাড়া, ও কেশব মহাজনপাড়া।
হাতি মাথার খাড়া পাহাড় বেয়ে পাহাড়ি জনগণের উঠানামার সুবিধার্থে ২০১৫ সালের ১৩ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় ৩০৮ ফুট দীর্ঘ লোহার সিঁড়ি। এই সিঁড়ি পথ দিয়ে পাহাড় চূড়ায় যেতে ৩০০টি ধাপ পেরোতে হয়।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ার লালন শাহের মাজার ভ্রমণ: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ
মায়ুং কপাল বা হাতি মাথা নামের উৎপত্তি
অদ্ভূত আকৃতির এই পাহাড় প্রাকৃতিকভাবেই গঠন পেয়েছে হাতির মাথার মত আর এ কারণেই ‘হাতি মাথা’ বা 'হাতিমুড়া' নামকরণ। ‘মায়ুং কপাল’ নামের উৎপত্তি এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ত্রিপুরাদের কাছ থেকে। তারা ‘হাতি’ বোঝাতে ‘মায়ুং’ এবং ‘মাথা’ বোঝাতে ‘কপাল’ শব্দ ব্যবহার করে, আর এ দুয়ে মিলেই পাহাড়ের নাম হয়েছে হাতি মাথা।
এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত এই পাহাড়টি। স্থানীয়দের অনেকে একে হাতি মুড়া বলে ডাকে। চাকমাদের কাছে এটি ‘এঁদো সিরে মোন’ নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন:তাজিংডং ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও খরচ
মায়ুং কপাল পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
পাহাড়ি বনের মাঝ দিয়ে নির্মিত সিঁড়ির নিচ থেকে উপরের দিকে সিঁড়ির প্রান্ত দেখা যায় না। দেখে মনে হয় যেন সিঁড়ির ধাপগুলো আকাশেরও উপরে উঠে গেছে। আর তাই সিঁড়ি নির্মাণের পর থেকে স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে পাহাড়ের দারুণ একটি নাম প্রচলিত হয়, আর সেটি হচ্ছে- ‘স্বর্গের সিঁড়ি’। এরকম নাম এবং সিঁড়ির অনিন্দ্য দৃশ্যের জন্যই গত কয়েক বছর ধরে পাহাড় ট্রেকারদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হাতি মুড়া
হাতি মুড়া পৌঁছার দীর্ঘ ট্রেইলপথের একঘেয়েমিতা দূর করেছে খরস্রোতা চেঙ্গি নদী। নদীর ওপর দিয়ে পাড়াপাড়ের জন্য রয়েছে কাঠের সাঁকো। এর পরে বিস্তৃত সমতল ভূমির দু’পাশে কোথাও জুম ক্ষেত, কোথাও বা ধু ধু প্রান্তর। এমন মাঠ পেরোতেই দেখা মিলবে অদ্ভূত নামের এক পাহাড়ি গ্রামের। ‘বানতৈসা’ নামের এই গ্রামে ত্রিপুরাদের বসবাস।
বানতৈসার পর স্বর্গের সিঁড়ির আগ পর্যন্ত আর কোনও জনপদ নেই। তবে উঁচু-নিচু রাস্তা ধরে এগোনোর সময় পাহাড়ের আনাচে-কানাচে চোখে পড়বে ছোট ছোট মাচাঘর। দীর্ঘ পায়ে হাঁটা পথে এখানকার কুয়া থেকে বরফ ঠান্ডা পানিতে গলা ভিজিয়ে নেয়া যায়।
আরও পড়ুন: ২০২৪ সালে ভিসা ছাড়াই যেসব দেশে যেতে পারবেন বাংলাদেশিরা
হাতিমাথা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছতেই সামনে দেখা যাবে প্রায় ১২০ ডিগ্রি কোণ করে বেঁকে উপরের দিকে উঠে গেছে স্বর্গের সিঁড়ি। কমপক্ষে এক থেকে দেড় ঘন্টা লাগবে এই সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় পৌঁছতে।
স্বর্গে নিয়ে না গেলেও এই সিঁড়ির শেষ প্রান্ত পর্যটকদের পৌঁছে দেয় নয়নাভিরাম সুন্দর এক গ্রামে। সেই চূড়া থেকে প্রায় পুরো খাগড়াছড়ি শহরটাই দেখা যায়। মনে হয় যেন নেপাল বা ভুটানের কোনও পর্যটন স্পট।