কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দি ছিলো আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো। বিশ্বজুড়ে লকডাউনের প্রকোপটা ধীরে ধীরে হালকা হওয়ার পর থেকে সেই বিধিমালাতেও আসছে শিথিলতা। সেই সাথে যারা ভ্রমণের মাঝে জীবনের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে পান তাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলার দিন শেষ হতে যাচ্ছে। যে দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে হিমালয়ের দেশ নেপালও আছে। শত বছরের পবিত্র স্থাপনায় সমৃদ্ধ দেশটি সারা বিশ্বের পর্যটকদের প্রিয় দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশি পর্যটকরা কিভাবে নেপালের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবেন- তা নিয়েই আজকের ভ্রমণ বিষয়ক ফিচার।

নেপালের জগদ্বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানসমূহ

কাঠমান্ডু

নেপালের সাংস্কৃতিক রাজধানী কাঠমান্ডু হল সেই জায়গা যেখানে নেপালের বেশিরভাগ অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়, কারণ এই শহরেই রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জনাকীর্ণ মহানগর কাঠমান্ডুর দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে দরবার স্কোয়ার যেটি সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে বেশ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। স্থাপনাটির অনেকাংশেরই পুনরুদ্ধারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ের উপর স্বয়ম্ভুনাথের প্রাচীন বৌদ্ধ কমপ্লেক্স থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকার অপূর্ব দৃশ্য চোখে পড়ে।

আরও পড়ুন: নাজমুন নাহার: পৃথিবীর ১৫০তম দেশ ভ্রমণ করে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাংলাদেশি পরিব্রাজক

অন্নপূর্ণা সার্কিট

উত্তর-পশ্চিম নেপালের অন্নপূর্ণা সার্কিট প্রত্যেক পর্বতারোহীকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে।, এই পথটি অন্নপূর্ণার বৈচিত্র্যময় দৃশ্য দেখিয়ে পর্যটকদের পৌছে দেয় হিমালয়ের চূড়ায়। যেতে যেতে দেখা হয় দীর্ঘ খাদের সংকীর্ণ উপত্যকা, নিঃসঙ্গ মালভূমি এবং সারিবদ্ধ খামারে বিভক্ত সবুজ উপ-ক্রান্তীয় উপত্যকা, কিছু ধর্মীয় স্থান এবং অদ্ভুত গ্রাম।

আরও পড়ুন: টেকনাফ-সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু

পোখারা

শান্ত হ্রদ, সবুজ উপকূলরেখা এবং পর্বতের দৃশ্য নিয়ে পোখারা সারা বিশ্বের ভ্রমণকারীদের প্রিয় গন্তব্য। অন্নপূর্ণার প্রবেশদ্বার হিসাবে পরিচিত লেক পার্শ্ববর্তী এই শহরটি ক্লান্ত পর্বতারোহীদের অবকাশ দেয় এবং রোমাঞ্চপ্রিয়দের প্যাডেল-বোট রাইড থেকে শুরু করে সাদা-জলে রাফটিং-এর সুযোগ দেয়।

পোখারার তিনটি হ্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো ফেওয়া লেক। এখানে দেবী বারাহি ভগবতীকে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির সহ একটি দ্বীপও রয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতি সপ্তাহের শেষে অনুষ্ঠান হয়।

নাগরকোট

যারা কঠোর শারীরিক পরিশ্রম ছাড়াই হিমালয়ের সৌন্দর্য এবং মহিমা অনুভব করতে চান, নাগারকোট তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা। উচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত এই জায়গাটি থেকে হিমালয়ের আটটি পর্বতমালার দৃশ্য দেখা যায়।

এখানকার নাগারকোট ভিউ টাওয়ারটি হিমালয়ের উপরে সূর্যোদয় দেখার জন্য নেপালের সেরা জায়গা হিসাবে পরিচিত।

আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন মহামায়া, উপভোগ করুন প্রকৃতির সৌন্দর্য

নেপাল ভ্রমণের কিছু মজার অভিজ্ঞতা

পর্বতারোহণ নিছক ঘোরাঘোরির সাথে যোগ করে আলাদা রোমাঞ্চ যা পুরো ভ্রমণটাকে স্মরণীয় রাখে। কিন্তু নেপাল সবচেয়ে সাহসী রোমাঞ্চপ্রিয়দেরও চমকে দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। আর তা হলো বাঞ্জি জাম্পিং। নেপাল ভ্রমণের সমস্ত ক্রিয়াকলাপের মধ্যে এটি গত কয়েক বছরে দ্রুত হারে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকরা মাথা থেকে পায়ের পাতা অব্দি কেঁপে ওঠার জন্য বাঞ্জি জাম্পিং করতে যায়।

বাঞ্জি জাম্পিং সর্বপ্রথম হয় নেপালের ভোটে কোশি নদীর উপর দুই পাহাড়ের মাঝের সুদীর্ঘ খাদে। এখন এটি সমগ্র বিশ্বে বাঞ্জি জাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত স্পটগুলির মধ্যে একটি। ১৬০ মিটার উচ্চতার খাদটি নেপাল-তিব্বত সীমান্তের কাছে অবস্থিত, যা শুধু নেপালেই নয়; সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ বাঞ্জি জাম্পিং। যে ঝুলন্ত সেতু থেকে লাফ দেওয়া হয় তা নেপালের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু।

আরও পড়ুন: দেশে অবকাশে থাকার শীর্ষ ৩ জায়গা

এরপরেই দারুণ আরেকটি অভিজ্ঞতা হতে পারে রাফটিং ও কায়াকিং। ভোটে কোশি, লোয়ার সেটি, ত্রিশূলী, কালী গন্ডকী, সূর্য কোশি, কমলি এবং মারশিয়াংদী নদীগুলো কায়াকিং, ক্যানোয়িং এবং রাফটিং এর জন্য সুপরিচিত। এই নদীগুলোর জন্যই নেপালকে সাদা পানির রাফটিং এবং কায়াকিংয়ের জন্য বিশ্ব সেরা গন্তব্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

পোখারার ফেওয়া লেক থেকে শুরু হওয়া ২ দিনের দীর্ঘ রাফটিং-এর সীমানা চিতওয়ান জাতীয় উদ্যান পর্যন্ত।

নেপাল ভ্রমণের আরও একটি কারণ হলো প্যারাগ্লাইডিং। আর এর জন্য পোখারার সারংকোট হচ্ছে এক নাম্বার। এখানে বর্ষাকাল বাদে সব মৌসুমেই প্যারাগ্লাইড করা যায়। তবে মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে ফেওয়া লেক এবং ৮,০০০ মিটারের উপর থেকে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।

আরও পড়ুন: সীতাকুণ্ড ডে ট্যুর: একদিনে ঘুরে আসুন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মহামায়া লেক

বাংলাদেশ থেকে নেপাল-এ যাতায়াত ব্যবস্থা

বাংলাদেশ থেকে নেপালে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম আকাশপথ। কাঠমান্ডুর জন্য টিকেট বুক করতে হবে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টকে গন্তব্য করে। বাংলাদেশি পর্যটকরা এখন ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে নেমে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাবেন। প্লেনের কোম্পানি ও পর্যটনের মৌসুম ভেদে যাওয়া-আসা নিয়ে মোট খরচ পড়বে ১৫ থেকে ৭৪ হাজার টাকার মতো। কাঠমান্ডুর ফ্লাইট সাধারণত বিলম্বিত হয়, এরপরেও যথাসম্ভব আগে টিকেট কেটে রাখা ভালো।

প্রথমবার গেলে ভিসা প্রয়োজন হয় না, কিন্তু একই বছরে দ্বিতীয়বার যেতে হলে মাল্টিপল ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মাল্টিপল ভিসার চার্জ ২ হাজার ৭০০ টাকা, ৩০ দিনের ৪ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৯০ দিনের জন্য ১১ হাজার ২৫০ টাকা।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করার নিয়ম: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও খরচ

স্থলপথে ট্রেন ও বাসে করে গেলে যাতায়াত খরচটা অনেক কমে আসে। তবে সেক্ষেত্রে ভারতের ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হয়। গন্তব্য স্থানের নাম দিতে হয় চ্যাংরাবান্ধা বা রানীগঞ্জ।

ঢাকার গাবতলী থেকে উত্তর বঙ্গের বুড়িমারী পোর্টের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি বাস ছাড়ে। এসি ও নন-এসি ভেদে এগুলোর ভাড়া ৬৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা।

চ্যাংরাবান্ধা সীমান্তে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে ভারতের রাণীগঞ্জ সীমান্তে যেতে হবে। এর জন্য চ্যাংরাবান্ধা থেকে প্রথমে কুচবিহার হাইওয়ে পর্যন্ত অটোরিক্সায় তারপর বাসে করে শিলিগুঁড়ি। অটোরিক্সার ভাড়া নিবে ২০ রুপি আর বাস ভাড়া পড়বে ৮০ রুপি। এখান থেকে আরেকটি বাসে করে পানির ট্যাংকি। তারপরেই পায়ে হাটা দূরত্বে রাণীগঞ্জ সীমান্ত। এভাবে চ্যাংরাবান্ধা থেকে রাণীগঞ্জ যেতে মোট খরচ পড়বে ১২০ রুপি, সময় যাবে সব মিলিয়ে প্রায় ৪ ঘন্টা।

আরও পড়ুন: বগালেক, দার্জিলিং পাড়া হয়ে কেওক্রাডং মানেই হারিয়ে যাওয়া রূপকথার রাজ্যে

যে বিষয়টি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, ইমিগ্রেশন অফিস বিকাল ৫টাতেই বন্ধ করে দেয়, তাই তার আগেই সেখানে পৌঁছতে হবে।

নেপালের কাকড়ভিটাতে ইমিগ্রেশন-এর কাজ শেষ হওয়া মানেই নেপাল চলে আসা হয়েছে। কাকড়ভিটা বাস স্টান্ড থেকে দুপুর ৩ থেকে ৫টা নাগাদ কাঠমুন্ডু ও পোখারা’র বাস পাওয়া যায়। এসি বাসে জনপ্রতি ১৮০০ রুপি, অন্যদিকে নন এসি বাস নেয় ১৪০০ রুপি ভাড়া। কাকড়ভিটা থেকে পোখারার জার্নিটা বেশ লম্বা; প্রায় ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা।

নেপালের ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

ভিসা আবেদনের জন্য আবেদনকারীর এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, এনআইডি কার্ড এবং পাসপোর্ট জমা দিতে হবে।

উদ্যোক্তাদের যে কাগজপত্র জমা দিতে হবে

অনলাইন ভিসা জমা দেয়ার সময় আসল ট্রেড লাইসেন্স (নোটারাইজড ও ইংরেজি অনুবাদ সহ) এবং বৈধ বাংলা ট্রেড লাইসেন্স এবং ভিজিটিং কার্ড অবশ্যই আপলোড করতে হবে।

চাকুরীজীবীদের ক্ষেত্রে

নিয়োগকর্তার ইংরেজি অনুবাদকৃত এবং নোটারিকৃত মূল ট্রেড লাইসেন্স ও বৈধ বাংলা ট্রেড লাইসেন্স, ভিজিটিং কার্ড ও বৈধ আইডি কার্ড অনলাইন আবেদনের সময় আপলোড করতে হবে।

আরও পড়ুন: সুন্দরবনের কোথায়, কীভাবে যাবেন?

শিক্ষার্থী হলে করণীয়

বৈধ আসল স্টুডেন্ট আইডি কার্ড এবং সর্বশেষ শিক্ষাগত প্রশংসাপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি বা কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি সুপারিশ চিঠি অনলাইন জমা দেয়ার সময় আপলোড করতে হবে।

"গ্রুপ ভিসা" আবেদনের জন্য

একটি কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়/অফিসিয়াল লেটার প্যাডে পাসপোর্ট নম্বর, বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশ ও স্বাক্ষর, সরকারি সীলমোহর সহ একটি নামের তালিকা জমা দিতে হবে। আবেদনের আগেই সেই চিঠি দূতাবাসে ফ্যাক্স করতে হবে।

সর্বক্ষেত্রে আবেদনের সময়

বাংলাদেশ থেকে যারা যাচ্ছে তাদের কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা রিটার্ন টিকেট প্রদর্শন করতে হবে।

আরও পড়ুন: সাজেক ভ্রমণ: ঘুরে আসুন মেঘে ঢাকা স্বর্গে

নেপাল-এর পর্যটকদের জন্য থাকার হোটেল

কাঠমুন্ডুর সুপরিচিত পর্যটন এলাকা থামেলে প্রতিটি অলিতে-গলিতে হোটেল ও রেস্তোরার ছড়াছড়ি। অনলাইনে দেশে বসেই দেখে নেয়া যায় এখানকার হোটেলগুলোর অবস্থা। অধিকাংশ ভ্রমণকারীরা সরাসরি থামেলে এসে শহর ঘুরে দেখার সময় হোটেল দেখে সুবিধামত বুকিং করে ফেলে। হোটেল গুলো ক্যাটেগরির উপর নির্ভর করে প্রতিদিনের জন্য চার্জ করে ১হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। হোটেলের ধারে কাছেই মিলে যাবে খাবার হোটেল।

শেষাংশ

পুরোনো তীর্থস্থান ঘোরার সময় নেপালিদের ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। তারা এমনিতেই যথেষ্ট অতিথিপরায়ণ। বহিরাগতদের থেকে সদ্বব্যবহার পেলে তারা অনেক সহায়তা করে। মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে এয়ারপোর্টের বাইরে মানি একচেঞ্জ থেকে টাকা ভাঙ্গালে ভালো রেট পাওয়া যায়। হোটেল বুকিংয়ের ক্ষেত্রে গরম পানির সুব্যবস্থা আছে কিনা দেখে নেয়া উচিত কারণ নেপাল শীত প্রধান দেশ।

আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটিতে পর্যটকদের ঢল