সংস্থাটি বলছে, মহামারিকালে বাবা-মা, কমিউনিটি ও স্বাস্থ্য সেবাগুলো যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে মাসিক টিকাদান সেবা গ্রহণের হার কোভিড-১৯-এর আগের পর্যায়কে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের উপ-প্রতিনিধি ভিরা মেন্ডোনকা বলেন, ‘এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন এবং এটি নিঃসন্দেহে হাজার হাজার শিশুর জীবন বাঁচাবে। এ গতি যাতে বজায় থাকে এবং কোনো শিশু যাতে বাদ না পড়ে তা নিশ্চিত করার জন্য টিকাদান প্রচেষ্টায় সহায়তা অব্যাহত রাখতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এ বছরের শুরুতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং বাংলাদেশ কার্যকরভাবে লকডাউনের ভেতর দিয়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। প্রথম দিকের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সরকার এ মূল সেবা অব্যাহত রাখায় ইউনিসেফ গুরুত্বপূর্ণ টিকাগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত করে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মা, নবজাতক, শিশু ও কিশোরী স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিচালক ড. মো. শামসুল হক বলেন, ‘লকডাউনে বিধিনিষেধের কারণে অনেক বাবা-মা তাদের শিশুদের টিকা দিতে বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিয়ে ভয়ের মধ্যে ছিলেন। অন্যদিকে টিকাদান সেবা যে অব্যাহত ছিল সেটাই জানতেন না অনেকে। ফলস্বরূপ মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়ে টিকা গ্রহণের হার ব্যাপকমাত্রায় কমে যায়’
বাংলাদেশে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে বছরে ৩৮ লাখ শিশুকে টিকা দেয়া। এপ্রিল ও মে মাসে ২ লাখ ৮৪ হাজারেরও বেশি শিশু পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন মিস করেছে, যা মাসিক লক্ষ্যের এবং কোভিডের আগের পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অংশীদারদের সহায়তায় টিকাদান কর্মসূচি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছে। টিকার মজুদ এবং টিকাদানের সময়গুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। ইউনিসেফ মহামারির কারণে ভীতি ও উদ্বেগ মোকাবিলা করে শিশুদের টিকা দিতে এবং তাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে তাদের অভিভাবকদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে একটি প্রচারাভিযান চালাতে সহায়তা করেছে।
একই সময়ে ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও কোভিড-১৯ চলাকালে স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য নিরাপদ টিকাদান এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নির্দেশিকা তৈরি ও প্রশিক্ষণ দিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। এছাড়া মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতীয় প্রচেষ্টায় সহায়তা দিতে এ পর্যন্ত ইউনিসেফ ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দ্রুত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি কমিউনিটিতে সচেতনতা বাড়াতে জোরদার কর্মসূচি গ্রহণের কারণে জুন থেকে টিকাদানের হার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মওলা বক্শ চৌধুরী বলেন, ‘যেসব শিশু টিকা গ্রহণ করতে পারেনি আমরা তাদের নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করছি এবং আস্থা বাড়াতে বাবা-মা ও যত্নকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছি। জুন এবং জুলাই মাসে, আমরা টিকাদানের দিক থেকে প্রাক-কোভিড পর্যায়কে ছাড়িয়ে গিয়েছি এবং আমাদের মাসিক লক্ষ্যের ১০০ শতাংশেরও বেশি অর্জন করেছি। আমরা শিশুদের জন্য বাড়তি কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে টিকাদানের ধারাবাহিকতায় যে বিচ্ছেদ পড়েছে তা পূরণের পরিকল্পনা করেছি।’
টিকাদানে উল্লেখযোগ্য অর্জন থাকা সত্ত্বেও, বেশ কিছু উদ্বেগের ক্ষেত্রও রয়েছে। কোভিড ভাইরাস সংক্রমণ রোধে পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি দেশগুলোর মধ্যে একটি যা তার বার্ষিক হাম-রুবেলা টিকাদান কার্যক্রম ও তার প্রচারাভিযান স্থগিত রেখেছিল, যা মার্চে সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল। তখন থেকে স্থানীয় পর্যায়ে বেশ কিছু হামের দুর্ভাব লক্ষ্য করে যায়, যা দমন করা গেলেও, জাতীয় হাম-রুবেলা কার্যক্রম ২০২০ সালের মধ্যে পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৯ মাস থেকে ৯ বছর বয়সী ৩ কোটি ৪০ লাখ শিশুকে লক্ষ্য করে হতে যাওয়া এ টিকাদান কার্যক্রম বাচ্চাদের মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করবে।
ভিরা মেন্ডোনকা বলেন, ‘জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে আমাদের কাছে যত ধরনের উপায় রয়েছে তার মধ্যে টিকা হচ্ছে অন্যতম সাশ্রয়ী একটি উপায়। বাংলাদেশে শিশুদের বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে অবদান রাখার প্রতিশ্রুতিতে ইউনিসেফ অটল রয়েছে এবং আমরা হাম, রুবেলা কার্যক্রম পুনরায় তাড়াতাড়ি শুরু করার জন্যে সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’
ইউনিসেফ এককভাবে বিশ্বে টিকার বৃহত্তম ক্রেতা, যা বাংলাদেশসহ প্রায় ১০০টি দেশের পক্ষে নিয়মিত টিকাদান এবং প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার জন্য বছরে টিকার ২০০ কোটিরও বেশি ডোজ কিনে থাকে।
বাংলাদেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, পেরটুসিস বা হুপিং কফ, টিটেনাস, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ-বি, নিউমোকোকাস, পলিওমেলাইটিস, হাম ও রুবেলাসহ ১০টি রোগের টিকা দেয়া হয়।