মানসিক সুস্থতাই যেখানে মুখ্য, মৌলিক চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা বিনোদনের দাবিটা সেখানে অকুন্ঠচিত্তে মেনে নেওয়া যায়। পরিবার, আত্মীয় স্বজন অথবা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আনন্দমুখর সময় কাটানো ভ্রমণের প্রশান্তিটাকে আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয়। সেখানে খেলাধুলা আর মুক্ত পাখির মত নেচে-গেয়ে বেড়ানো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্তগুলোর অবতারণা করে। আর যখন তাতে দেওয়া হয় নতুনত্ব বা উদ্ভাবনের পরশ, তখনি উন্মোচিত হয় বিনোদনের এক বিস্ময়কর দিগন্ত। এই দিগন্তকে আলিঙ্গন করতেই বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম ওয়াটার পার্ক ‘মানা বে’ স্বাগত জানাচ্ছে গোটা দেশবাসীকে। চলুন, সদ্য চালু হওয়া এই অভিনব পার্কটির ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

দেশের প্রথম ওয়াটার পার্ক মানা বে’র উদ্বোধন

২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর বিশাল আড়ম্বরে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম ওয়াটার পার্ক মানা বে। ২২ তারিখ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টায় অনুষ্ঠান শুরু হয় এক প্রাণবন্ত কার্নিভাল দিয়ে। টানা দুই দিন মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া মুখরিত হয়ে থাকে ওপেনিং প্যারেড, ওয়ারিয়র ড্যান্স, হাক্কা ড্যান্স ও স্টিল্ট ওয়াকিং, ব্যান্ড সঙ্গীতসহ নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে।

মানা বে’র চেয়ারম্যান মাসুদ দাউদ আকবানির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে পার্ক উন্মুক্ত করা হয় দর্শনার্থীদের জন্য। এ সময় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। যুক্তরাজ্যের উপহাইকমিশনার ম্যাট ক্যানেল উপস্থিত ছিলেন বিশেষ অতিথি হিসেবে।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সেরা ১০ মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত

মানা বে নির্মাণের নেপথ্যের মানুষেরা

প্রায় ৬০ হাজার বর্গ মিটার জমির উপর নির্মিত এই স্থাপনা দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ওয়াটার পার্ক। পার্কটির নির্মাণসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে সম্পূর্ণ ব্রিটিশ বিনিয়োগে পরিচালিত এসিএস টেক্সটাইলস লিমিটেড।

এই অ্যাকোয়া অ্যাডভেঞ্চার প্রকল্পটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ওভাইস আকবানি, সাশিন হাসান এবং চেয়ারম্যান মাসুদ দাউদ আকবানি।

পার্কের রাইডগুলোর সরবরাহ, স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বনামধন্য রাইড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হোয়াইটওয়াটার।

পুরো ওয়াটার পার্কটির স্থাপত্য নকশা তৈরি করে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছে অবকাশ যাপন স্থাপনা শিল্পে বিশ্ববিখ্যাত স্প্যানিশ কোম্পানি অ্যামিউজমেন্ট লজিক।

আরও পড়ুন: বিশ্বসেরা ১০ পিরামিড: চিরন্তন কিংবদন্তির খোঁজে

কোথায় এই মানা বে ওয়াটার পার্ক

ঢাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ধরে যাবার পথে মেঘনা ব্রিজের পরেই মানা বে ওয়াটার পার্ক। জায়গাটি পড়েছে ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়া ইউনিয়নে।

কী কী আছে এই ওয়াটার পার্ক মানা বে-তে

দেশের অন্যান্য থিম পার্ক থেকে যে বৈশিষ্ট্যটি একে আলাদা করেছে তা হলো- পার্কের কেন্দ্রে ওশেনিয়া মহাদেশীয় বা পলিনেশিয়ান স্টাইলের একটি কৃত্রিম আগ্নেয়গিরি।

বাস্তবমুখর করার জন্য এতে যোগ করা হয়েছে শব্দ, আলো, ধোঁয়া এবং আগুনের স্পেশাল ইফেক্ট। ৪৫ মিটার ভিত্তির উপর ২৫ মিটার উঁচু আগ্নেয়গিরিটি দর্শনার্থীদের সম্মুখে সগর্বে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

তারপরেই এর অনন্য বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে স্প্ল্যাশ ওয়ার্কস ওয়াটার অংশের কৃত্রিম নদী, যেটি এশিয়ার দীর্ঘতম লেজি রিভার বা কৃত্রিম নদীগুলোর মধ্যে একটি।

৭০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪ মিটার প্রস্থের জলাশয়গুলোতে সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য বরাবর সুনির্দিষ্ট বিরতিতে বসানো হয়েছে ১৫টি ইম্পেলার মেশিন। এগুলো নদীর কেন্দ্রীয় গতিপথ এবং শাখাগুলোর মধ্যে পানির প্রবাহ সচল রাখে। ডিনো বিচ ওয়াটার পার্কের কৃত্রিম নদীর আদলে এখানকার পানিতেও ব্যবহার করা হয়েছে কৃত্রিম শিলা পাথর।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকলে ভিসা ছাড়াই যেতে পারবেন যেসব দেশে

রাইড ও অ্যাট্রাকশন

১৭টি রাইড ও ৪টি অ্যাট্রাকশনের বৈচিত্র্যময় এক পার্ক এই মানা বে। এখানে মুল আকর্ষণগুলোর মধ্যে প্রথমেই বলা যেতে পারে অ্যাকোয়ারাশের ম্যাট ওয়াটার স্লাইডারের কথা। এখানে পুরো রাইড ভ্রমণ সম্পন্ন হয় চারটি সর্পিলার সেগমেন্টে: লাভা ড্যাশ, অ্যাকোয়াড্রেনালাইন, ভার্টিগো ভর্টেক্স, লুপ অফ ফেইথ।

টাইডাল টুইস্ট-এর টিউব ওয়াটার স্লাইডারগুলো হলো- রিপটাইড বিপ্লব, টেম্পেস্ট টুইস্টার, সাইক্লোন ফিউরি, ও টার্বো টিউব।

ওহানা ফলসে আছে জয়রাইডার, ভেলোসিটি ভার্টেক্স রাফটিং স্লাইড। আর ফ্লোরাইডার-এ আছে সার্ফ সিমুলেটর।

কৃত্রিম নদীর ইঞ্চান্টেড ওয়াটার, টাইডাল পুল ও হাইড্রো গ্রুভে জলকেলি, আর ব্লিসপুল বে’তে সূর্যস্নান অবিস্মরণীয় একটি দিনের উপহার দিতে পারে।

বাচ্চাদের জন্য আলাদাভাবে আছে কিডস ওয়াটার স্লাইড ফানস্ট্রিম, অ্যাকোয়া শুটার স্প্ল্যাশটোপিয়া, রেইন ফোর্ট্রেস ৫ এবং ইন্টারেক্টিভ অ্যাডভেঞ্চার শেলশ্যাক।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের শীর্ষ ১৫টি ঐতিহ্যবাহী স্থান

অভিজাত রেস্তোরাঁ ও ক্যাবানা

মানা বে’তে আছে ৭টি রেস্তোরাঁ, ৪টি ফুড ট্রাক এবং নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য ছায়াদানকারী ১৮টি অভিজাত তাবু বা ক্যাবানা।

রেস্তোঁরাগুলোর আভ্যন্তরীণ নকশা প্রতিটির মেনু এবং বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তৈরি করা হয়েছে। যেমন: মাছের রেস্তোরাঁগুলোতে সাধারণ আঁকাবাকা রেখা দিয়ে ঢেউ, মুক্তো দিয়ে সামুদ্রিক আবহ তৈরি করা হয়েছে। এক রঙের বিশেষত নীল রঙের প্যালেটে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

মানা বে’কে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিতে বাইট অফ প্যারাডাইস যথেষ্ট। এর সঙ্গে সানকিসড নামের ক্যাফেতে পাওয়া যাবে খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে শান্ত পরিবেশের এক অদ্ভূত মেলবন্ধন।

সামুদ্রিক ও গরমেট খাবার উপভোগের জন্য ঢুঁ মারা যেতে পারে দ্য ওশেন্স বাউন্টি এবং ফিয়েস্তা ডেল মার-এ।

দ্বীপাঞ্চল এবং গ্রীষ্মমন্ডলীয় স্বাদের জন্য আছে আইল্যান্ড ব্রিজ। এর সুস্বাদু খাবার এবং রিফ্রেশিং পানীয় পরিশ্রান্ত করে আবার অ্যাডভেঞ্চারের দিকে ঠেলে দেয়।

আরও পড়ুন: আপনি কি মার্কিন ডলার না কিনে বিদেশে ভ্রমণ করতে পারবেন?

মিষ্টান্ন ও আইসক্রিম প্রেমিরা নিমেষেই ভিড় জমাতে পারেন ওনো’তে।

বাচ্চাদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে টামি টিক্লার্স এবং বিটস অ্যান্ড বাইট্স ফুড কোর্ট দুটি।

এদের টিকি বার এবং সার্ফ শ্যাক বার দুটি একদমি অ্যালকোহল মুক্ত। বরং এগুলো উপকূলবর্তী গ্রীষ্মমন্ডলীয় মকটেল এবং স্বাস্থ্যকর ঠাণ্ডা সতেজ পানীয়ে ভরপুর।

ঢাকা থেকে ওয়াটার পার্ক মানা বে যাওয়ার উপায়

ঢাকা থেকে সড়ক পথে এই প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরত্ব পেরোতে প্রায় ২ ঘন্টার মত সময় লাগতে পারে। গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে মুন্সীগঞ্জ গামী যে কোনও বাসে উঠে নেমে যেতে হবে চর বাউশিয়া বাসস্ট্যান্ড।

রাস্তা পার হওয়ার পর ডানদিকে তথা ঢাকার দিকে ২ মিনিট হেটে যেতে হবে। অতঃপর হাতের বায়ে প্রথম যে রাস্তাটি পড়বে সেটি ধরে আরও ২ মিনিট হাটলেই পাওয়া যাবে মানা বে-এর প্রবেশদ্বার।

এছাড়া নিজস্ব গাড়ি কিংবা গাড়ি রিজার্ভ নিয়েও আরও সহজে যেতে পারবেন। পার্কে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে।

আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ

ওয়াটার পার্ক মানা বে-তে প্রবেশ মূল্য

৪ ফুটের উপরে সকল প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য মানা বে’তে ঢোকার টিকেট ৬ হাজার টাকা। ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতার বাচ্চাদের টিকেট মূল্য ৩ হাজার টাকা। ৩ ফুটের নিচের শিশুদের জন্য প্রবেশ সম্পূর্ণ ফ্রি।

এর প্রবেশ মূল্যের মধ্যেই সকল রাইডের মূল্য অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ ভেতরে ঢোকার পর আলাদা করে কোন রাইডের জন্যে টিকেট কাটার প্রয়োজন নেই।

মানা বে’তে প্রবেশের সময় টিকেট কাটার ব্যবস্থা তো আছেই, তাছাড়া মানা বে-এর হেড অফিস থেকেও আগে থেকে টিকেট কাটা যাবে। মানা বে-এর হেড অফিস গুলশান ২-এর সানমার টাওয়ার ২-এর ১৪তম তলায়।

এছাড়া মানা বে অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে অনলাইনেও টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। অনলাইনে টিকেট নেয়ার জন্য ভ্রমণকারীর নাম, ইমেইল ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার দিতে হবে। অনলাইনে টিকেটের মূল্য পরিশোধের জন্য রয়েছে সব ধরনের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এর সুব্যবস্থা।

এখন পর্যন্ত মানা বে’তে কোন ডিসকাউন্ট বা আলাদা কোনও অফার নেই। তবে ৫০ জনের বেশি সদস্য নিয়ে প্রবেশের বেলায় কিংবা কর্পোরেট বুকিং-এর ক্ষেত্রে ডিসকাউন্টের সুবিধা আছে। এই জন্যে সরাসরি কল দিয়ে কথা বলা যেতে পারে অথবা যোগাযোগ করা যেতে পারে ফেসবুক পেজ-এ।

আরও পড়ুন: নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণ গাইড: যাওয়ার উপায় ও আনুষঙ্গিক খরচ

মানা বে ওয়াটার পার্ক কতক্ষণ খোলা থাকে

মানা বে ওয়াটার পার্ক সপ্তাহের প্রতিদিনি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। সপ্তাহান্তের শুক্রবার ও শনিবার, এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। আর বাকি দিনগুলোতে দর্শনার্থীরা সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মানা বে ঘুরতে পারেন।

শেষাংশ

বাংলাদেশের প্রথম প্রিমিয়াম ওয়াটার পার্ক বিশ্ব মানের পর্যটন স্থাপনায় এক বিরাট পদচিহ্ন। চিত্তাকর্ষক রাইডিং সুবিধাগুলোকে নিরাপত্তা বিধি মেনে তৈরি করার পরেও রাখা হয়েছে ২৪ ঘণ্টা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি তাৎক্ষণিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এখানে নির্দ্বিধায় বিচরণের উন্মেষ ঘটায়।

পার্কের অনন্য স্থাপত্য, নকশা, সঙ্গীত, নৃত্য এবং শিল্প ভ্রমণকারিদের পলিনেশিয়ার সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে নিমজ্জিত করবে। সর্বপরি, বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে এই থিম পার্ক অবকাশ যাপনের এক নতুন ধারা। যা একদম নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করবে প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটানোটাকে।

আরও পড়ুন: কুমিল্লার ১০ দর্শনীয় স্থান