করোনা মহামারির ফলে দীর্ঘ লকডাউনের পর ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ধীরে ধীরে উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে পর্যটন দেশগুলো। সেই সারিতে আছে উদ্যাননগরী হিসেবে খ্যাত পরিচ্ছন্ন শহরের দেশ সিঙ্গাপুরও। ২০১৯ এর সমীক্ষানুযায়ী, পৃথিবীর সর্বাধিক ভ্রমণকৃত শহরগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর শীর্ষ পাঁচ-এ অবস্থান করছে। সিঙ্গাপুর পর্যটন বোর্ড-এর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৯১ লাখ দর্শনার্থী সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেছিল যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে তিনগুণ। কি কারণে দেশটি এত বেশি দর্শনার্থীদের আকষর্ণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, এর বিশেষত্বটাই বা কি- সে ব্যাপারে বিস্তারিত নিয়েই এবারের ফিচার সিঙ্গাপুর ভ্রমণ।

সিঙ্গাপুর-এর দর্শনীয় জায়গাগুলো

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র উপকূলবর্তী ৭২৮.৬ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট্ট দেশটির সৌন্দর্য্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকদের কাছে এক অপার বিস্ময়।

প্রথমেই বলা যায় ঐশ্বর্যময় মেরিনা বে স্যান্ডস-এর (Marina Bay Sands) কথা। এই রিসোর্ট কমপ্লেক্সটির বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে এর শপিং মল যার মাঝ দিয়ে খাল প্রবাহিত হয়েছে, আর্টসায়েন্স মিউজিয়াম এবং মেরিনা বে স্যান্ডস স্কাইপার্ক অবজারভেশন ডেক যেখান থেকে ডাবল হেলিক্স ব্রিজ (Double Helix Bridge), বন্দর, সমুদ্র তীরবর্তী বাগান ও দিগন্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়বে।

এখানকার মূল আকর্ষণ হলো মার্লিয়ন (Merlion) যেটি হলো সিংহের মাথা এবং মাছের দেহের সমন্বয়ে একটি অদ্ভূত ভাস্কর্য। মুখ থেকে ফোয়ারা বের হতে থাকা এই ৭০ টন ওজন এবং ৮.৬ মিটার লম্বা ভাস্কর্যটি বানানো হয়েছে সিঙ্গাপুরের এক পৌরাণিক প্রাণির আদলে।

বিশ্বের বৃহত্তম দৈত্যাকার নাগোরদোলায় চড়তে হলে যেতে হবে সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার-এ। এখান থেকে দিগন্তরেখার পাশাপাশি মাধ্যাকর্ষণের ভয় মিশ্রিত দৃষ্টি বিস্তৃত হবে ইন্দোনেশিয়ার স্পাইস দ্বীপপুঞ্জ এবং মালয়েশিয়ার জোহর প্রণালী পর্যন্ত।

এরপরেই সিঙ্গাপুরের ল্যান্ডমার্ক হচ্ছে প্রাণবন্ত উদ্ভিদ জীবনে সমৃদ্ধ কোলাহল বিহীন বে ইস্ট গার্ডেন। 

ক্লাউড ফরেস্ট ফ্লাওয়ার ডোমের (Cloud Forest Flower Dome) বিশাল তরুবিথিকা লাখো পর্যটকদের বিস্ময়ের খোরাক জোগিয়ে আসছে।পাশেই অর্চার্ড রোড-এ সামনে পড়বে উচ্চমানের শপিং মল এবং অত্যাধুনিক সিনেমা হলগুলো।

সিনেমাপ্রেমিদের জন্য দারুণ একটি ঘোরার জায়গা হতে পারে ওয়ার্ল্ড সেন্টোসার রিসোর্ট-এর ইউনিভার্সাল স্টুডিও পার্ক। পার্কটি দারুণভাবে সাজানো হয়েছে বিনোদন জগতের বিভিন্ন পসরা দিয়ে যেখানে সিনেমাপ্রেমিরা ঘুরে আসতে পারবেন হলিউড, মাদাগাস্কার এবং প্রাচীন মিশর থেকে। সেন্তোসা দ্বীপের আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড অ্যাকোয়ারিয়াম-এ দেখা হবে ডলফিনের সাথে।

সিঙ্গাপুরের দশ তলা জুয়েল চ্যাঙ্গি (Jewel Changi) বিমানবন্দরটি যে কোন ভ্রমণকারির চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এর বিশেষ আকর্ষণ হল বিশ্বের সর্বোচ্চ ইনডোর ঝর্ণা, চল্লিশ মিটার উচু এইচএসবিসি রেইন ভর্টেক্স (HSBC Rain Vortex)। বিমানবন্দরের তিনটি টার্মিনালের প্রত্যেকটিতেই আছে নিজস্ব বাগান। এছাড়া রয়েছে দুটি মুভি থিয়েটার, বিনোদন কর্নার, ইনডোর পার্ক এবং অত্যাশ্চর্য পর্যবেক্ষণ ডেক।

আরও পড়ুন: নেপাল ভ্রমণ: শত বছরের তীর্থস্থান ঘুরতে হিমালয়ের দেশে

রোমাঞ্চপ্রিয়দের জন্য সিঙ্গাপুরের বিশেষ আকর্ষণ

সিঙ্গাপুরের অপূর্ব জায়গাগুলোর ঘুরে দেখা ছাড়াও ভ্রমণপিপাসুদের যারা নিজেদের একটু দুঃসাহসী মনে করে থাকেন তাদের চাহিদা মেটাতে এখানে আছে অ্যাড্রেনালিন রাশের দারুণ ব্যবস্থা।

সিঙ্গাপুর নদীবিধৌত এলাকা ক্লার্ক কোয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো রিভার্স বাঞ্জি-জাম্পিং। এই রাইডে পাঁচ জন যাত্রীকে ক্যাপসুলে উঠানো হয় মাটি থেকে। এরপর বোতাম টিপে যাত্রী সহ পুরো ক্যাপসুলটাকে ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার বেগে নিক্ষেপ করা হয় ৬০ মিটার উচ্চতায়।

এখানকার আরেকটি রাইড এক্সট্রিম সুইং-এর অভিজ্ঞতা আরো শ্বাসরূদ্ধকর। এক্সট্রিম সুইং-এ নিক্ষেপের পর ক্যাপসুলটি শূন্যে দুলতে থাকে। আরেকটি আছে ট্রামপোলিন বাঞ্জি, যেখানে ৮ মিটার উচ্চতায় ক্যাপসুলটি উল্টে-পাল্টে ডিগবাজি খেতে থাকে।

এছাড়া সেন্তোসা সমুদ্র সৈকতে ভলিবল খেলার পাশাপাশি কায়াকিং এবং স্কিমবোর্ডিং বহিরাগতরা একবারের জন্য হলেও উপভোগ করে দেখে।

পড়ুন: টেকনাফ-সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু

বাংলাদেশে থেকে সিঙ্গাপুর যাতায়াত

ঢাকা থেকে প্রায় সোয়া চার ঘণ্টার ভেতর বিমানে করে সরাসরি সিঙ্গাপুর পৌঁছা যায়। বিমান কোম্পানি এবং ভ্রমণের সময়ভেদে এয়ার টিকেটে খরচ পড়বে প্রায় সাড়ে ৩৫ থেকে ৫১ হাজার টাকা।

এয়ারপোর্টে পৌছে সেখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আছে মাস র্যাপিড ট্রাঞ্জিট বা এমআরটি। সাশ্রয়ী ভাড়ায় ভ্রমণের জন্য এয়ারপোর্ট থেকেই ওঠা যাবে মেট্রো রেলে। এই শাটল ট্রেনে চার ডলারের মধ্যে চ্যাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে পৌছা যাবে মেরিনা বে’তে। এছাড়াও সারা সিঙ্গাপুরের অভিজাত সড়ক জুড়ে আছে পাবলিক বাস। এগুলোতে সর্বোচ্চ তিন ডলার পর্যন্ত ভাড়া পড়তে পারে। ট্যাক্সির বিকল্প হিসেবে যাতায়াত খরচ বাঁচানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে গ্র্যাব। এটি হচ্ছে বাংলাদেশের পাঠাওয়ের মত সিঙ্গাপুরের পাবলিক রাইড সার্ভিস।

সিঙ্গাপুর ভ্রমণ ভিসা পেতে করণীয়

ঢাকায় সিঙ্গাপুরের কনস্যুলেট বাংলাদেশিদের ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার কাজ সম্পন্ন করে থাকে।

সাধারণ বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের সিঙ্গাপুরে আসার আগে প্রবেশ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। বাংলাদেশি কূটনৈতিক এবং অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের সিঙ্গাপুরে যেতে ভিসার প্রয়োজন হয় না।

ঢাকা কনস্যুলেট থেকে প্রদানকৃত সিঙ্গাপুর ভিসাটি কিন্তু সরাসরি অভিবাসন পাস নয়। এটি সিঙ্গাপুরে ভ্রমণের জন্য প্রাক-প্রবেশের অনুমতি মাত্র। ইমিগ্রেশন পাস প্রদানের বিষয়টি মুলত নির্ধারণ করেন ইমিগ্রেশন অ্যান্ড চেকপয়েন্ট অথরিটি কর্মকর্তারা সিঙ্গাপুরে প্রবেশের মুহূর্তে। সম্পূর্ণ ভিসা প্রক্রিয়াকরণ করতে সময় লাগে জমা দেয়ার দিন বাদ দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ কার্যদিবস।

ভিসার জন্য আবেদনটি জমা দিতে হয় অনলাইনে ঢাকাস্থ কনস্যুলেটের অনুমোদিত ভিসা এজেন্টের মাধ্যমে। পুরো ভিসা প্রসেসিং-এর খরচ ৩০ সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার; এখানে এজেন্টের ফি অন্তর্ভূক্ত নয়।

পড়ুন: সীতাকুণ্ড ডে ট্যুর: একদিনে ঘুরে আসুন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মহামায়া লেক

ভিসা আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

→ সিঙ্গাপুরে আগমনের তারিখ থেকে কমপক্ষে ছয় মাসের বৈধতাসহ বৈধ পাসপোর্ট

→ যথাযথভাবে পূরনকৃত আবেদনপত্র

→ সিঙ্গাপুরের স্থানীয় কারো মাধ্যমে ইস্যু করা পরিচিতিপত্র বা এলওআই

সাধারণের ক্ষেত্রে পত্রটি অবশ্যই কমপক্ষে ২১ বছর বয়সী একজন সিঙ্গাপুরের নাগরিক বা সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা দ্বারা স্বাক্ষরিত হতে হবে।

ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীদের জন্য সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত কোন প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পরিচিতি হিসেবে কাজ করতে পারে।

→ এক কপি পাসপোর্ট আকারের রঙিন ছবি যা সর্বোচ্চ তিন মাস পুরোনো হতে পারবে। ছবির পেছনে সাদা পটভূমি, ধর্মীয় বা জাতিগত রীতিনীতি গ্রহণযোগ্য কিন্তু মুখের বৈশিষ্ট্য গোপন করে এমন কিছু ব্যবহার করা যাবে না। মুখের ছবি চিবুক থেকে মাথা পর্যন্ত ২৫ মিমি দৈর্ঘ্য এবং ৩৫ মিমি প্রস্থ হতে হবে।

→ আবেদনকারীর বায়োডাটার একটি ফটোকপি

পড়ুন: বগালেক, দার্জিলিং পাড়া হয়ে কেওক্রাডং মানেই হারিয়ে যাওয়া রূপকথার রাজ্যে

সিঙ্গাপুর-এ পর্যটকদের জন্য আবাসিক হোটেল

বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ভ্রমণপিপাসুর প্রিয় গন্তব্য সিঙ্গাপুরে পর্যটকদের আবাসন নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তবে পর্যটনের মৌসুম হোক বা না হোক আবাসিক হোটেলগুলোতে অগ্রিম বুকিং দিয়ে গেলে খরচ কিছুটা কমবে। মেরিনা বে এবং সেন্তোসার হোটেলগুলো অনেক ব্যয়বহুল। সেদিক থেকে মোস্তাফা সেন্টার সংলগ্ন মিনি বাংলাদেশ জায়গাটিতে অনেক হোটেল আছে যেগুলোতে সাধ্যের মধ্যেই রাত্রী যাপন সম্ভব। এখানে সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে ভাড়া পড়তে পারে প্রায় ২৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ২১,৮০০ হাজার টাকা।

সিঙ্গাপুরের খাবার-দাবার

সমগ্র মালয় উপদ্বীপ জুড়ে খুবই জনপ্রিয় একটা খাবার হলো লাক্সা। এটি মুলত চাইনিজ এবং মালয় ধরনের সংমিশ্রণে শাকসবজি সহ চালের নুডলস। বিভিন্ন ধরনের উপাদান দিয়ে খাবারটির পরিবেশনে ভিন্নতা আনা হয়। প্রায় ১৮৯ টাকার মধ্যে এক বাটি লাক্সা পাওয়া যায়।

সিঙ্গাপুরের জাতীয় খাবারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি খাবার ঝাল কাঁকড়া। বহিরাগতদের কাছে এটি সিঙ্গাপুরিয়ান খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এর অনেক সংস্করণে সসকে ঘন করার জন্য ডিম এবং স্বাদের জন্য মরিচ এবং টমেটো দেয়া হয়।

সিঙ্গাপুরে কাঁকড়ার আরেকটি জনপ্রিয় সংস্করণ হল লবণাক্ত ডিমের কুসুম কাঁকড়া। এগুলোর দাম বেশ চওড়া। জনপ্রতি ৫,৮২১ থেকে শুরু করে ৬২৯৩ টাকা পর্যন্ত। এখানকার সস যুক্ত মুরগী পোলাও স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এই ডিশটি ১৮৯ থেকে ১১৩৩ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।

সুগন্ধী চালের নাসি লেমাক সবচেয়ে সুপরিচিত মালয় খাবার। নারকেলের দুধ, লবণ এবং কখনও কখনও পান্ডান পাতা দিয়ে রান্না করার কারণে খাবারটিতে দারুণ সুবাস তৈরি হয়। নাসি লেমাকের দাম ৩৪৬ টাকা।

পড়ুন: সাজেক ভ্রমণ: ঘুরে আসুন মেঘে ঢাকা স্বর্গে

শেষাংশ

সিঙ্গাপুর ভ্রমণ-এর পূর্বে কিছু ব্যাপার মনে রাখা আবশ্যক। সাগরের উপকন্ঠে হলেও এখানকার  গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু দেশটির গড় তাপমাত্রা সারা বছর ২৬ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখে। উচ্চ আর্দ্রতার দরূণ প্রচুর ঘাম হয়, তাই পরার জন্য রঙিন পোশাক পরিহার করা উত্তম। সাথে ছাতা থাকাও জরুরি, কারণ এখানে কয়েক মিনিটের মধ্যে ফোস্কা পড়া রোদ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

সিঙ্গাপুর দেশটি আইন ও নিয়ম-নীতিতে কড়াকাড়ির জন্য বেশ সুপরিচিত। রাস্তায় থুথু ফেলা, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা, চুইংগাম আটকানোর মতো কাজগুলো ধরা পড়লে জরিমানা হতে পারে।