বস্তুকণাযুক্ত বায়ুদূষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় বাহ্যিক ঝুঁকি। তবে বৈশ্বিক হিসেবে এর বেশিরভাগ প্রভাব পড়বে ছয়টি দেশে, বাংলাদেশ এই দেশগুলোর একটি। অর্থাৎ, দেশটি বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর দেশ।
এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) থেকে পাওয়া নতুন তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক দূষণ যেমন ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, তেমনি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাবও বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য যদি বিশ্ব স্থায়ীভাবে সূক্ষ্ম কণা দূষণ (পিএম২.৫) কমাতে পারে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির গড় আয়ু ২ বছর ৩ মাস বাড়বে। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত আয়ুষ্কাল ১৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন জীবন-বছর বাড়বে।
এসব তথ্যে জানা যায়, বস্তুকণা দূষণ মানব স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাহ্যিক ঝুঁকি। ধূমপানের তুলনায় আয়ুষ্কালের উপর এর প্রভাব বেশি, অ্যালকোহল ব্যবহার এবং অনিরাপদ পানির চেয়েও এর প্রভাব তিন গুণেরও বেশি এবং গাড়ি দুর্ঘটনার মতো পরিবহনে আঘাতের চেয়ে এর ক্ষতির পরিমাণ ৫ গুণেরও বেশি।
তবে বিশ্বের সব দেশে দূষণের চ্যালেঞ্জ সমান নয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর অন্য সব স্থানের চেয়ে দূষণের প্রভাব মারাত্মক বেশি। এই অঞ্চলে বিশ্বের চারটি সবচেয়ে দূষিত দেশ এবং বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ বাস করে।
একিউএলআই এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে বর্তমানে যে উচ্চ মাত্রার দূষণ চলছে তা অব্যাহত থাকলে বাসিন্দাদের গড় আয়ু প্রায় ৫ বছর কমে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা শীর্ষে
অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বিশিষ্ট পরিষেবা অধ্যাপক এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআইসি) এর সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে একিউএলআই এর স্রষ্টা মাইকেল গ্রিনস্টোন বলেছেন, ‘বৈশ্বিক আয়ুষ্কালের ওপর বায়ু দূষণের তিন-চতুর্থাংশ প্রভাব মাত্র ছয়টি দেশের ওপর পড়ছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। যেখানকার বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কারণে মানুষ তাদের তাদের জীবন থেকে এক থেকে ছয় বছরেরও বেশি সময় হারায়।’
একিউএলআই গত পাঁচ বছর ধরে এই দেশগুলোর বায়ুর গুণমান ও এর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিগুলোর তথ্য স্থানীয় মিডিয়া এবং রাজনৈতিক কভারেজ থেকে সংগ্রহ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, অনেক দূষিত দেশে বায়ু দূষণের মৌলিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকা এর দুটি সবচেয়ে মর্মান্তিক উদাহরণ। দূষণের কারণে মোট মৃত্যুর ৯২ দশমিক ৭ শতাংশই এই অঞ্চলে হয়।
এরপরও এশিয়া ও আফ্রিকার মাত্র ৬ দশমিক ৮ এবং ৩ দশমিক ৭ শতাংশ সরকার তাদের নাগরিকদের সম্পূর্ণ উন্মুক্ত বায়ু মানের তথ্য সরবরাহ করে।
এশিয়া ও আফ্রিকার মাত্র ৩৫ দমমিক ৬ ও ৪ দশমিক ৯ শতাংশ দেশের বায়ুর মানের স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে।
বায়ু দূষণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করলেও বিশ্বব্যাপী বায়ু মানের পরিকাঠামোতে সে অনুপাতে বিনিয়োগ করতে দেখা যায়না দেশগুলোর সরকারকে।
যদিও এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের জন্য একটি বৃহৎ বৈশ্বিক তহবিল রয়েছে। এর বার্ষিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করে, সেখানে বায়ু দূষণের বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দিতে দেখা যায়না।
প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ বায়ু দূষণের জন্য জনহিতকর তহবিলে তিন লাখ মার্কিন ডলারের নিচে বরাদ্দ পায় (অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একক পরিবারের ব্যবহৃত বাড়ির বর্তমান গড় মূল্য)।
ক্লিন এয়ার ফান্ড এর তথ্য অনুসারে, চীন ও ভারতের বাইরে এশিয়ায় মাত্র ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ পৌঁছায়। যেখানে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পায়।
আরও পড়ুন: বায়ু দূষণ থেকে মানুষকে বাঁচান: পরিবেশ অধিদপ্তরকে হাইকোর্ট
একিউএলআই এবং বায়ু মানের প্রোগ্রাম ইপিআইস- এর পরিচালক ক্রিস্টা হাসেনকপফ বলেছেন, ‘সুশীল সমাজ ও সরকারের নির্মল বায়ু প্রচেষ্টার প্রধান অগ্রাধিকার হতে পারে সময়োপযোগী, নির্ভরযোগ্য, বায়ুর মানের উন্মুক্ত তথ্য। জনগণ ও সরকারের কাছে যে তথ্যের অভাব রয়েছে তা সরবরাহ করা এবং এটি আরও সচেতন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও কাজে লাগে।
তিনি আরও বলেন, ‘সৌভাগ্যবশত, আমরা আজ অনুপস্থিত এই অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য তহবিল বাড়ানোর মাধ্যমে পরিবর্তন আনার একটি বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি।’
চীন
যদিও বিশ্বজুড়ে বায়ু দূষণ কমানোর চ্যালেঞ্জ কঠিন, তবে চীন এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
২০১৩ সাল থেকে দূষণ ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ কমিয়েছে দেশটি। দেশটি ২০১৪ সালে থেকে ‘দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে।
যদি পরিবর্তনগুলো বজায় থাকে তবে চীনারা গড়ে ২ দশমিক ২ বছর বেশি বাঁচার আশা করতে পারে।
যদিও চীনে দূষণ এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা থেকে ছয় গুণ বেশি। যার ফলে জনগণের গড় আয়ু আড়াই বছর কমেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
দক্ষিণ এশিয়ার মতো, প্রায় সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ) এখন দূষণের অনিরাপদ মাত্রা বিরাজ করছে বলে মনে করা হয়। কিছু অঞ্চলে এক বছরে দূষণ ২৫ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দূষিত অংশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের গড় আয়ু ২ থেকে ৩ বছর কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ঢাকার বায়ু দূষণ: হাইকোর্টের আরও ৩ দফা নির্দেশনা
মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকা
যদিও এশিয়ান দেশগুলো চরম মাত্রার বায়ু দূষণ সম্পর্কে সর্বাধিক আলোচিত; তবে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের আফ্রিকান দেশগুলো বিশ্বের দশটি সবচেয়ে দূষিত দেশের মধ্যে রয়েছে।
এই অঞ্চলের সবচেয়ে দূষিত এলাকায় দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা থেকে ১২ গুণ বেশি এবং জনগণের গড় আয়ু ৫ দশমিক ৪ বছর কমেছে।
এই অঞ্চলে এইচআইভি/এইডস ও ম্যালেরিয়ার মতো বায়ু দূষণও সুপরিচিত ঘাতক হিসেবে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
ল্যাটিন আমেরিকা
গড় বায়ুর গুণমান সমগ্র বিশ্বজুড়েই অনিরাপদ অবস্থায় থাকলেও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে দূষণের হার যথেষ্ট কম।
তবে গুয়াতেমালা, বলিভিয়া ও পেরুর মতো দেশগুলো এ অঞ্চলের সবচেয়ে দূষিত দেশ। এগুলোর দূষণের মাত্রা ভারতের পুনে এবং চীনের হারবিনের মতো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুর গুণমান নির্দেশিকা মেনে চললে এসব দেশের বাসিন্দাদের গড় আয়ু ৩ থেকে ৪ দশমিক ৪ বছর বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র
১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট পাস হওয়ার আগের সময়ের তুলনায় আমেরিকানরা ৬৪ দশমিক ৯ শতাংশ কম বস্তূকণা দূষণের সংস্পর্শে আসছেন। এ কারণে তাদের গড় আয়ু ১ দশমিক ৪ বছর বেড়েছে।
ইউরোপ
১৯৯৮ সালে এয়ার কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক নির্দেশিকা শুরু হওয়ার পরে আগের তুলনায় ইউরোপের বাসিন্দারা বর্তমানে প্রায় ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ কম দূষণের সংস্পর্শে এসেছে। এর কারণে তাদের গড় আয়ু ৪ দশমিক ৫ বছর বেড়েছে।