জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার এফএওর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক সম্মেলনের ৩৬তম অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রথমবারের মতো ঢাকায় আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজন করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুধাবিতে তার বাসস্থান থেকে ভার্চুয়ালি উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকে যোগ দেন।
এসময় তিন দফা পরামর্শ পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমি পরামর্শ দিতে চাই যে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো উচিত।’
দ্বিতীয় পরামর্শটি উত্থাপন করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ অঞ্চলের এফএও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কৃষি খাতে জৈব-প্রযুক্তি, ন্যানো টেকনোলজি ও রোবোটিক্সের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ভাগ করে নেয়া দরকার।’
তৃতীয় সুপারিশে তিনি বলেন, ‘আধুনিক কৃষিতে যেহেতু বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন। তাই কৃষি খাতে অর্থায়ন ও সহায়তার জন্য একটি বিশেষ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারি অন্যান্য খাতের মতো কৃষি খাতেও প্রভাব ফেলেছে। ২০২০ সালে মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছিল। যার ফলে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের সময়োপযোগী এবং কার্যকর পদক্ষেপ এই সেক্টরটিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। আমরা যান্ত্রিকীকরণসহ বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। যাতে বাধাহীনভাবে খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।’
আরও পড়ুন: প্রযুক্তির যুগে নতুন প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া যাবে না: প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারি আমাদের দেখিয়েছে যে, এই ধরনের বিপর্যয়ের মুখে মানুষ কতটা অসহায়। এটি আরও দেখিয়েছে, মানব জাতি এক হয়ে কীভাবে এই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়ই মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৩০৫.৭ মিলিয়ন মানুষ এখনও ক্ষুধার্ত। আমরা সবাই আন্তরিক প্রচেষ্টা করলে, তাদের জন্য সহজে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি।’
বাংলাদেশের কৃষি খাতের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদিও দেশে জিডিপিতে কৃষি খাতের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমে যাচ্ছে, কিন্তু নিরঙ্কুশ অবদান কমেনি; বরং বেড়েছে। ২০০৫-২০০৬ সাল থেকে কৃষি জিডিপি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষির ভাগ কমে যাওয়া সত্ত্বেও কৃষি এখনও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে রয়ে গেছে। এখনও ৪০ শতাংশ শ্রমশক্তিকে জীবিকা প্রদান করে কৃষির মাধ্যমে। বর্তমানে প্রায় ২২.৭ মিলিয়ন মানুষ, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারী সরাসরি কৃষি খাতে কর্মরত।
তিনি বলেন, এছাড়াও এখন অনেক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প মৌলিক কাঁচামাল যেমন- চাল মিলিং, চিনি, চা, ফলের রস, মশলা, ভোজ্যতেল, তামাক, পাটের বস্ত্র, তুলা বস্ত্র, স্টার্চ এবং অন্যান্যের জন্য সম্পূর্ণরূপে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এইভাবে, কৃষি এখনও বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে রয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ১৩ বছরে ধান, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বছরে প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করে এটি ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: সরকার বাংলাদেশের বিহারীদের জীবনমান উন্নয়নে পরিকল্পনা করছে: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী জানান, বিশ্বে বাংলাদেশ পাট ও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে ২য়, ধান ও সবজি উৎপাদনে ৩য় এবং চা উৎপাদনে ৪র্থ স্থানে রয়েছে। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে।
তিনি বলেন, আমাদের সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, একের পর এক সহায়তা ও প্রণোদনা; সেইসাথে আমাদের কঠোর পরিশ্রমী কৃষকদের প্রচেষ্টার কারণে এই অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, উদ্যোক্তাতারাও একটি সমৃদ্ধ বেসরকারি খাত তৈরি করেছে। যেখানে কৃষি ক্রমবর্ধমান এবং প্রসারিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সাফল্য সত্ত্বেও, আমরা বুঝতে পারি যে প্রকৃত অর্থে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। কারণ এই খাতগুলোতে প্রকৃতি ও জলবায়ু সংক্রান্ত অস্বাভাবিকতার সরাসরি প্রভাব রয়েছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন টেকসই কৃষির জন্যও একটি বড় হুমকি। ‘সুতরাং, আমরা আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে বিভিন্ন অভিযোজন ও প্রশমন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করছি।’
বাংলাদেশের জীবিকানির্বাহী কৃষিও বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের তাই উচ্চফলনশীল খাদ্য বৃদ্ধি কমফলনশীল খাদ্যের মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য আমরা আধুনিক কৃষি পদ্ধতি যেমন যান্ত্রিকীকরণ, ভাসমান কৃষি, ছাদে চাষ, হাইড্রোপনিক ও অ্যারোপোনিক ফার্মিং এবং সমন্বিত চাষে রূপান্তরিত করছি।
প্রধানমন্ত্রী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য এফএও এর ৩৬তম আঞ্চলিক সম্মেলনকে উন্মুক্ত ঘোষণা করেছেন।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে আঞ্চলিক সম্মেলনে বক্তব্য দেন খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মহাপরিচালক কিউ ডংইউ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এসএম রেজাউল করিম।
আরও পড়ুন: সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে মেরিন ক্যাডেটদের ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী