এক-দুই শতবর্ষ নয়, কয়েক দশকও নয়, কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার কর্মী ও জেনোসাইড বিশেষজ্ঞগণ।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
‘বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন-২০২৩’ উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবাহমান সংগঠন আমরা একাত্তর, ডায়াসপোরা সংগঠন ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম (ইবিএফ) এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম’ ৭১ যৌথভাবে এ মিট দ্যা প্রেস-এর আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সংসদ সদস্য আরমা দত্ত। আমরা একাত্তরের চেয়ারপার্সন মাহবুব জামানের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন।
নেদারল্যান্ডসের সাবেক সংসদ সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল বলেন, ‘স্বাধীনতার একান্ন বছরেও ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। এর অন্যতম কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় চলমান স্নায়ুযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের ওপর তখনকার বৈশ্বিক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হ্যারি বলেন, ‘বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন স্নায়ুযুদ্ধের জন্য বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তাদের অস্ত্র সরবরাহ করে। অন্যদিকে ভারত তখন রাশিয়ার পক্ষে। তাই সঙ্গত কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়ে জানলেও না জানার ভান করে। পশ্চিমারা পাকিস্তানকে বন্ধু ভাবায় এতদিন ধরে বাংলাদেশে সংগঠিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি।’
আরও পড়ুন: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে 'গণহত্যা' ঘোষণার আহ্বান
তিনি বলেন, ‘আর্মেনিয়ান জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে একশ’ বছর লাগলেও বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে অত সময় লাগবে না বলে আশা করি। কয়েক দশকও নয়, আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই এটি পেতে চাই।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ জেনোসাইডের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বিশ্বব্যাপী জনমত আদায়ে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে একদিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
আরমা দত্ত বলেন, ‘আমি নিজে একজন শহীদ সন্তান। বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও ন্যাক্কারজনক গণহত্যা ঘটে, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে। জাতিসংঘ এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। আমাদের দাবি আদায়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বন্ধুদের ধন্যবাদ।’
প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘১৯৭১ সালের প্রতিটি ঘটনাই গণহত্যার, যা দেশে-বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশি গণহত্যা নিয়ে ইইউ পার্লামেন্ট ও ইউএস কংগ্রেসে আলোচনা হয়েছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
আমস্টারডামের ভ্রিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক ড. এ্যানথনি হলসল্যাগ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বাংলাদেশে জেনোসাইডের বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ এখনও চলমান। এটি শেষ হলে স্বীকৃতি আদায়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’
মাহবুব জামান বলেন, বাংলাদেশ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ২০২০ সাল থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে কাজ করছে আমরা একাত্তর। এ উপলক্ষে তারা বাংলাদেশে দূতাবাস আছে এমন সবগুলো দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যাতে সেসব দেশের সংসদে এটি নিয়ে আলোচনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যেখানে ইউরোপীয় প্রতিনিধিরাও অংশ নিচ্ছেন যারা এই জেনোসাইডের স্বীকৃতি চান।
আরও পড়ুন: পশ্চিমাদের অবশ্যই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হওয়া পাক গণহত্যার কথা স্বীকার করতে হবে: শাহরিয়ার
বিদেশি প্রতিনিধিরা আগামী এক সপ্তাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগ ঘুরে দেখবেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইবুন্যালের প্রধান প্রসিকিউটর, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করবেন। এছাড়াও তারা রায়েরবাজার ও মিরপুর জল্লাদখানা, বঙ্গবন্ধু জাদুঘর ও জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করবেন এবং পরে চট্টগ্রাম ভ্রমণ করবেন। চট্রগ্রামে ও তারা বিভিন্ন বধ্যভূমি পরিদর্শন, শহীদ স্বজনদের সাথে সাক্ষাত করবেন। দুই দিনের সফরে সেখানে তারা সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নেবেন।
যুক্তরাজ্যের সিনিয়র সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘আমি আমার জীবনের ২০ বছর কাটিয়েছি বাংলাদেশের জেনোসাইড বিষয়ে পড়াশোনা করে। এই সম্মেলন ও ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে কী ঘটেছিল তা আরও ভালোভাবে জানতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ফলে এক ধাপ এগোনো গেছে। এখন পরবর্তী ধাপ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’
ইবিএফ-এর যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি আনসার আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য গণহত্যার শিকার ব্যাক্তিদের সাক্ষাৎকার নেবেন। পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন পার্লামেন্টে স্বীকৃতির বিষয়টি তুলে ধরা হবে।’
ইবিএফ এর নেদারল্যান্ডস শাখার সভাপতি ও প্রবাসী সংগঠন বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ) এর চেয়ারম্যান বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া বলেন, ‘আর্মেনিয়ান গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে একশ’ বছর লেগেছে। আমরা এতদিন লাগুক তা চাই না। বাংলাদেশের জন্মের ৫১ বছরেও গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি, তার অন্যতম কারণ আমাদের রাজনৈতিক বিভেদ; যা বিদেশেও বিদ্যমান। সব পক্ষ মিলে চাইলে এই কাজ আরও দ্রুত হবে বলে আশা করি।’
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ সন্তান ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।