দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা-যশোর বিস্তৃত অঞ্চলের ভবদহের ৫২টি গ্রাম ২০ বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে। বর্ষাকাল বিদায় নিয়ে শীতের আগমন ঘটলেও ভবদহ এলাকা এখনও জলাবদ্ধ। ফলে এসব এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিএডিসি) এই বিশাল এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তবে এর সফলতা নিয়ে সন্দিহান বাসিন্দারা।
ভবদহের দুঃখ
১৯৬১-৬২ সালে খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও যশোর জেলার অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হরি নদীর উপর ২১ ভেন্টের স্লুইস গেট নির্মিত হয়েছিল। এর কিছু দুরে ৯ ভেন্টের আরেকটি স্লুইস গেট স্থাপন করা হয়।
আরও পড়ুন: চাঁদপুর-সিলেট আন্তনগর ট্রেন এখনও স্বপ্ন!
সে সময় এ অঞ্চলে স্লুইস গেট নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল ভবদহ এলাকার অর্ধশত বিলের ফসলকে বন্যার পানি ও সাগরের নোনা পানি থেকে রক্ষা করা। কিন্তু মাত্র ২০ বছর পরে সেটি এখানকার মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হরি নদী ভরাট হতে থাকে এবং স্লুইস গেটগুলো ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ‘ভবদহের দুঃখ’ বলে পরিচিতি পেয়েছে।
হাটগাছা গ্রামের অনামিকা বিশ্বাস জানান, ঘরের চারপাশে পানি কিন্তু খাওয়ার উপযোগী নেই একটুও। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ঘরেই থাকে। ঘরের নিচ দিয়ে মাছ চলে বেড়ায় কিন্তু তা ধরে খাওয়ার কোন উপায় নেই। প্রভাবশালীরা সেখানে মাছ চাষ করছে।
সেচ পাম্প ‘লোকসান প্রকল্প’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিএডিসি) যৌথ উদ্যোগে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও ভবদহ স্লুইস গেট দিয়ে বাসিন্দাদেন জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
ভবদহ সংলগ্ন বিলে ফসল ফলাতে ও পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে এ বছরের শুরুতে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে স্থানীয়রা এই পদ্ধতিকে সাগরে ঢিল ফেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এর আগে ভবদহর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১২ সালে সরকার ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্রকল্পও কোন কাজে আসেনি। বছর দুয়েক আগে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে একটি প্রকল্প জমা দেয় যা বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে সেচ পাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
বিএডিসির যশোরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সেচ বিভাগ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান, এ অঞ্চলের বিলে ফসল ফলাতে ও মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবোকে বিএডিসি ৩০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) পাওয়ারের ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। যা রক্ষণাবেক্ষণে বিএডিসির ৮ জন শ্রমিকসহ একজন উপ-প্রকৌশলী সেখানে সার্বক্ষণিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু লিকেজ দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তা পাউবোকে অবহিত করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
আরও পড়ুন: দেশি প্রকৌশলীদের চেষ্টায় সচল গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের পাম্প
পাউবো যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, বিএডিসির কাছ থেকে ২০টি পাম্প পাওয়া গেলেও চাহিদার তুলনায় কম। তাই আরও বড় পাম্প নিতে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ২ বছর আগে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পড়ে আছে। সেটিরও অনুমোদন মেলেনি।
ভবদহ অঞ্চলের বিল কেদারিয়ার বাসিন্দা সত্য বিশ্বাস জানান, আশির দশকে ভবদহতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আজ ৪০ বছর পরও এই জলাবদ্ধতা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু প্রভাবশালীরা লাভবান হচ্ছে কারণ তারা সরকারি বরাদ্দ আনছে আর লুটপাট করছে।
ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই
নদীর তলদেশ পলিতে ভরে যাওয়ায় বিলের পানি কোথাও যেতে পারছে না। ফলে এসব বিলের পানি নামতে না পারায় মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম পিঠা খাওয়ার ধুম পড়েছে খুলনায়
স্থানীয় খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসির সেচ প্রকল্প কতটা সফল এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে হরি নদী খননসহ এর শাখা প্রশাখা খননের কোন বিকল্প নেই। ভবদহের জল হরি নদী দিয়ে ভদ্রা, ঘ্যাংরাইল হয়ে শিপসা নদীতে পড়ে সাগরে মিশে। তাই ভবদহের মধ্যে খালের মুখের বাঁধ অপসারণ করতে হবে।