চলমান রাজনৈতিক ও শ্রমিক অসন্তোষ দেশের অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করতে ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোট সরকারকে পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধ পালন করছে।
অন্যদিকে, মজুরি বৃদ্ধির জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের অব্যাহত বিক্ষোভ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়েছে।
বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, হতাহত ও যানবাহনে; প্রধানত বাসে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারবিরোধীদের বিক্ষোভ দেশের অর্থনীতিতেও আঘাত হেনেছে। কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি এখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, টাকার মান ৩০ শতাংশের বেশি কমে যাওয়া, দুই অংকের মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও শ্রমের উচ্চমূল্যের সঙ্গে লড়াই করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং এর সাবেক গভর্নরদের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
আলোচনাসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আমন্ত্রিত অর্থনীতিবিদরা মার্কিন ডলার সংকট, স্থিতিশীল বিনিময় হার ও মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে নীতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন।
আলোচনায় উপস্থিত বিশ্লেষকেরা অভিমত দিয়েছেন, গার্মেন্টস সেক্টরে উচ্চ মজুরির জন্য শ্রমিক অসন্তোষও এই খাতের তৈরি পোশাক কারখানার মালিক ও নীতি নির্ধারকদের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।
আরও পড়ুন: চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ৬ শতাংশ করেছে আইএমএফ
তবে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আগামী নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমতের পরামর্শ দেওয়া ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে তাদের কিছু বলার নেই।
ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অর্থনীতিকে বড় অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতির ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি হতে পারে।
মনসুর বলেছেন, ‘কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মনোভাবে নমনীয়তার কোনো লক্ষণ নেই। কয়েক দিনের জন্যও উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হলে, তা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এটি মুদ্রাস্ফীতির চাপ, ডলারের সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান মনসুর বলেন, আমদানি-রপ্তানি, বেসরকারি খাতের ঋণ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব সংগ্রহ এবং অন্যান্য সব খাত এই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তারা জানায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মূল উৎস রপ্তানি খাত। প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আসে পণ্য রপ্তানি থেকে।
তারা আরও জানায়, গত অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমেছে। সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালের অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রপ্তানি আয় হয়েছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার কম।
আরও পড়ুন: আমদানি নিয়ন্ত্রণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। এতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে অনেক জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা মনে করে যেভাবেই হোক রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া উচিত। সবাইকে দেশের অর্থনীতি ও স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান ইউএনবিকে বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ও সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের ক্রেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
সময়মতো পণ্য হাতে না পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারণে কিছু ক্রেতা ব্র্যান্ড রপ্তানির অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘ক্রেতারা উদ্বিগ্ন; তারা আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে চায়। ঢাকায় ক্রেতা ফোরামের পক্ষ থেকে একটি বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, একদিনের হরতালে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
অবরোধের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিশাল। অবরোধ চলাকালে কিছু দোকানপাট খোলা থাকে, তবে ক্রেতা আসে গুটিকয়েক। বিক্রিতে দৈনিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান হতে পারে।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সমস্যার দ্রুত সমাধান এবং অর্থনীতিকে বাঁচাতে সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, সবাইকে দেশের স্বার্থ সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
কারওয়ান বাজার কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন জানান, অবরোধে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে।
বিক্ষোভের দিনগুলোতে বাজারে পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমেছে।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ ইউএনবিকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতির সব খাতে প্রভাব ফেলে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতেই এর সমাধান করা উচিত।
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে অর্থনীতিতে দ্বিগুণ আঘাত আনবে।
তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অনিশ্চয়তার কারণে ক্রেতাদের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। উৎপাদনে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাসের প্রবণতা বেশ উদ্বেগজনক। মূলধন আমদানি হ্রাস মানে আউটপুট হ্রাস পাবে। এতে রপ্তানি আরও কমবে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ২০২৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাল বিশ্বব্যাংক
বিভিন্ন আর্থিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রপ্তানি খাত। কিন্তু এ খাত থেকেও আয় কমেছে।
পণ্য রপ্তানি থেকে মাসে গড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়। কিন্তু গত অর্থবছর ২০২২-২৩ সালের একই মাসের তুলনায় অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি ১৪ শতাংশ কমেছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৬ শতাংশ কমেছে।
পোশাক উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল তুলার আমদানি প্রায় ৩৯ শতাংশ কমেছে। সুতা, কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামালও প্রায় একই হারে কমেছে। পোশাক ছাড়া অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি ৩৬ শতাংশের বেশি কমেছে।