মাগুরায় করোনায় কর্মহীন ৪৩৮ জন শিল্পী কলাকুশলীর জন্য ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের সহায়তা বিতরণ তালিকায় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার ও একজন সহ সাধারণ সম্পাদকসহ কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই তালিকা তৈরি করা হয়।
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী নামে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিজ পরিবারের ১৪ জনসহ অন্তত ৫০ জনের নাম দিয়ে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যারা কেউ দুঃস্থও নন, শিল্পীও নন।
আরও পড়ুন: করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা: আর্থিক প্রণোদনা পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
একইভাবে শিল্পকলার সংগীত শিক্ষক অজিত রায়ের বিরুদ্ধে একই পরিবারের ৬ জনের নাম দিয়ে ৬০ হাজার টাকা তুলে নেয়াসহ শিল্প সংস্কৃতির সাথে নূন্যতম সংযোগ নেই এমন ব্যক্তিদের নাম দিয়ে লাখ লাখ টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি জেলা শহরে ২টি ফ্ল্যাট ও ২টি বাড়িসহ অন্তত ৩ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকের স্ত্রীকেও দেয়া হয়েছে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পীর প্রণোদনা। এর ফলে অনেক প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পী সহায়তা পাননি। এতে সরকারের এ মহতি উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জেলার শিল্পী সমাজের মধ্যে।
আরও পড়ুন: প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে সিরিজ মতবিনিময় সভা করবে অর্থ বিভাগ
লিখিত এক অভিযোগে জেলার কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী ওই তালিকায় শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে নূন্যতম যোগাযোগ না থাকা একাধিক ব্যক্তির নাম দিয়ে টাকা উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছেন।
তারা জানান, তালিকার ২২৯ নং সিরিয়ালে পবিত্র কুমার চক্রবর্তী নামে স্থানীয় একটি কাপড়ের দোকানের সেলসম্যানকে নাট্যশিল্পী হিসেবে দেখানো হলেও তিনি জীবনে কোনদিন স্টেজে উঠেছেন বলে শহরের কেউই জানেন না। তিনি জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর ভগ্নিপতি।
আরও পড়ুন: সময়মতো প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে: প্রধানমন্ত্রী
একইভাবে ২৩০নং সিরিয়ালের ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী বিশ্বজিতের ভাইপো, ২৫৫ সিরিয়ালের বরুন চক্রবর্তী বড়ভাই, ২৫৬ ইতি চক্রবর্তী ছোটবোন, ২৬৪ প্রনয় চক্রবর্তী ভাগ্নে, ২৬৫ প্রিয়াংকা চক্রবর্তী ভাগ্নি, ২৬৬ গোপাল চক্রবর্তী চাচাতো ভাই, ২৬৭ বন্দনা চক্রবর্তী ভাইয়ের বৌ, ২৬৮ প্রদীপ চক্রবর্তী চাচাতো ভাই এর ছেলে, ২৭০ কার্তীক চক্রবর্তী চাচাতো ভাই এর ছেলে, ২৭১ সুদীপ্ত চক্রবর্তী ভাতিজা, ২৭২ আনন্দ চক্রবর্তী ভগ্নিপতি, ২৭৪ বিথি চক্রবর্তী ছোট বোন ও ২৫৭ ছবি রানী ভট্টাচার্য ভাইয়ের স্ত্রী। এভাবে শিল্পীদের নাম দিয়ে পরিবারের সদস্যদের দিয়ে লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও তার সঙ্গীরা।
শিল্পকলা একাডেমীর সংগীত শিক্ষক অজিত রায় ও শহরের সাতদোহা পাড়া এলাকার একটি পরিবারের ৬ নারীর নাম দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরা হলেন সন্ধ্যা রানী ঘোষ (৪১৯), প্রিয়া ঘোষ (৪৪), রিয়া ঘোষ (৮৫), ডলি ঘোষ (১০৪), আপন ঘোষ (১০৫) ও লিলি ঘোষ (১৭২)। এদের কারোই শিল্প সংস্কৃতির সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ তাদের প্রত্যেকের নামে ১০ হাজার টাকা করে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। শহরের কেশব মোড়ের বাসিন্দা বর্তমানে স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায় অবস্থানরত সিগ্ধা পাল নামে এক সাবেক নৃত্য শিল্পী ও তার মায়ের নামে ১০ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কাস্টমস বিভাগে কর্মরত এক ব্যক্তির স্ত্রী সিগ্ধা পালের মাগুরা শহরে ২টি ফ্ল্যাট, ১টি বাড়ি ও একটি বিশাল বাগান বাড়ি রয়েছে। যার মূল্যমান কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা। স্বজনপ্রীতি করে তাকে ও তার মা জোসনা পালকে ১০ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারিভাবে যখন করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পীদের সহায়তা দেয়ার জন্য নামের তালিকা আহ্বান করা হয় তখন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও অজিত রায় এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি অসাধুচক্র একত্রে বসে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ও আইডি নম্বর সংগ্রহ করে নিজ মনগড়া একটি তালিকা প্রেরণ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রকৃত শিল্পীদের বিষয়টি জানতেই দেয়া হয়নি। অথবা তাদের আবেদন ফেলে দেয়া হয়েছে। যার ফলে প্রকৃত শিল্পীরা অনেকেই বঞ্চিত হলেও মুখচেনা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম দিয়ে তালিকা প্রেরণ করা হয়। ফলে সরকারের এত বড় একটি মহতি উদ্যোগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
অন্যদিকে, অচলা মন্ডল নামে এক নারীর নাম তালিকায় থাকলেও তালিকায় দেয়া ফোন নম্বরে ফোন দিয়ে ওই নারীর স্থলে সাতক্ষীরা থেকে আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ফোন ধরে।
অন্যদিকে শহরের তাতীপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিল্পী কবরী ঘোষের নাম থাকলেও তাকে ফোন করলে তিনি জানান, তিনি কোনো টাকা বা চেক পাননি। অথচ ইতোমধ্যে চেক বিতরণ করা হয়ে গেছে মর্মে জানিয়েছেন শিল্পকলা সংশ্লিষ্টরা।
মাগুরার বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শামসুজ্জামান পান্না, সাহিত্যিক এম এ হাকিম, লোক সাংস্কৃতি সংগঠক এ.টি.এম. আনিসুর রহমান, সাহিত্য সংগঠক অ্যাডভোকেট কাজী মিহির, সাহিত্যিক ও গীতিকবি লিটন ঘোষ জয়, কবি রহমান তৈয়বসহ একাধিক ব্যক্তি ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে জানান, শিল্প সংস্কৃতিক সঙ্গে যারা জড়িত তারা সাধারণত উদার মানবিক হবেন, এমনটিই ভাবা হয়ে থাকে। প্রকৃত শিল্পীরা যেখানে করোনার কারণে চরম অর্থ সংকটে অনেকে অনাহারে অর্ধাহারে আছেন। সেখানে শিল্পীদের জন্য দেয়া টাকা নয়-ছয় করে খরচ করা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। মাগুরা জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যানারে একটি অসাধু চক্র যেভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন তাতে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। এরা শিল্প সংস্কৃতির চরম শত্রু।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সহ সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যরা যদি পাওয়ার উপযোগী হন তাহলে তারা টাকা পেতেই পারেন। আমি কোনো স্বজন প্রীতি বা দুর্নীতি করিনি।’
এ প্রসঙ্গে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার জসিম উদ্দিন জানান, শিল্পকলা একাডেমী থেকে নামের তালিকা চেয়ে পাঠানোর পর দ্রুত তালিকা পাঠানো হয়েছে। ফলে কিছুটা অসামঞ্জস্য থাকতেই পারে। তালিকার সবাইকে টাকা দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
তবে একটি তালিকায় একই পরিবারের ১৪ জনের নাম থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক বলেন তিনি।
জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম জানান, কয়েকজন শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে তালিকা প্রস্তুত করতে। ভবিষ্যতে প্রকৃত শিল্পীরা যেন সকল ধরনের সহায়তা পান সেজন্য প্রচেষ্টা অব্যহত থাকবে।