বৃষ্টির পানি ওই এলাকার মানুষের খাবার পানির প্রধান উৎসহ। কিন্তু আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে বলেশ্বর নদের পাড়ের মানুষ তাদের মিষ্টি পানির উৎস হারিয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মাত্রাতিরিক্ত লবণ পানি পান করলে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
শরণখোলায় গিয়ে দেখা যায়, জলোচ্ছ্বাসে মিষ্টি পানির আধার পুকুর ও জলাশয় ভেসে গেছে। পুকুরগুলোতে লবণ পানি প্রবেশ করে মিষ্টি পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মানুষ ওই পানি মুখে দিতে পারছেন না। তারা খাবার পানির জন্য রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেক নারী পুরুষকে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। যুগ যুগ ধরে শরণখোলার মানুষ বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। কাছাকাছি মিষ্টি পানি না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে নানা কাজে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করছে।
নদ পাড়ের বগী গ্রামের জাকারিয়া সরদার জানান, খাবারের জন্য তারা পুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। কিন্তু আম্পানের সন্ধ্যায় জলোচ্ছ্বাসে তাদের মিষ্টি পানির পুকুরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে। এ পানি খাওয়া তো দূরের কথা মুখেও দেয়া যায় না। খাবার পানির জন্য তাদের অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে।
একই এলাকার হারুন হাওলাদার জানান, বছরের পর বছর ধরে তাদের এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। বাড়ির পাশে নদী এবং খালবিলে পানি থাকলেও ওই পানিতে অতিরিক্ত লবণ। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণ। এ কারণে তারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সারা বছর ধরে খান। কিন্তু আম্পান তাদের মিষ্টি পানির আধার নষ্ট করে দিয়েছে। খাওয়া ছাড়াও নানা কাজে প্রতিদিন অনেক পানির প্রয়োজন হয়। পানির জন্য তাদের মধ্যে হাহাকার তৈরি হয়েছে। তারা প্রতিদিন প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন।
নদ পাড়ের বাসিন্দা তহমীনা বেগম, নার্গিস আক্তার, দুলাল শেখসহ আরও কয়েকজন জানান, দুর্যোগ হলে খাবার পানি নিয়ে তাদের বেশি দুশ্চিন্তা হয়। এবারও তাদের মিঠা পানির পুকুর লবণ পানিতে ভরে গেছে। দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে তারা বাধ্য হয়ে লবণ পানি ব্যবহার করেন। লবণ পানি পান করার কারণে তাদের নানা রোগে ভুগতে হয়।
সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকসী জানান, মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত লবণ পানি পান করলে উচ্চ রক্তচাপ এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। মানবদেহে হাড়ক্ষয়, পেটের পীড়া, চর্মরোগসহ নানা রোগ হতে পারে। এমনকি হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণে মানুষ মারা যেতে পারেন। এ জন্য লবণাক্ত পানি পান না করা এবং খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ না খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ডা. প্রদীপ বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য মানুষের লবণের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিদিন একজনের জন্য গড়ে এক চামচের কম পরিমাণ লবণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার পানি না থাকলে এবং ভূপৃষ্ঠের পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। লবণ মানবদেহে পানি ধরে রাখে। পানি ধরে রাখার কারণে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি দীর্ঘদিন ধরে পান করলে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে।’
বাগেরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, শরণখোলা উপজেলায় মোট জনসংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার। প্রতিদিন একজন মানুষের জন্য গড়ে ৮০ লিটার পানির প্রয়োজন রয়েছে। সেই হিসেবে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে পানির যেসব ব্যবস্থা রয়েছে তাতে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাবে। বাকি মানুষ নানা উৎসহ থেকে পাওয়া পানির ওপর নির্ভরশীল।
শরণখোলা উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি এবং দাতা সংস্থার দেয়া সব মিলে এক হাজার ১২টি পন্ড স্যান্ট ফিলার (পিএসএফ) রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৫৪৭টি। দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সরকারি ৩৩২টি পিএসএফ অচল অবস্থায় পড়ে আছে। সারা বছর গড়ে শরণখোলায় উন্মুক্ত জলাশয়ের প্রতি লিটার পানিতে এক হাজার ৭০০ থেকে তিন হাজার ৫০০ পিপিএম লবণাক্ততা পাওয়া যায়। আর আম্পানের জলোচ্ছ্বাস যে পানিতে প্রবেশ করেছে ওই পানিতে লবণাক্ততার হার পাঁচ হাজার পিপিএম।
বাগেরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এফএম ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘শরণখোলায় ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ পানি লবণাক্ত। সেখানকার মানুষের খাবারের জন্য বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের অনেক আধার নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে পানির ব্যবস্থা অপ্রতুল রয়েছে।’
ইসমাইল হোসেন আরও জানান, বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি সেখানে আছে তাতে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মানুষের মাঝে সুপেয় পানি সরবারহ করা সম্ভব। কিন্তু আম্পানে তাও অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের মাঝে সুপেয় পানি সরবারহ করার জন্য শরণখোলায় ১৮টি ন্যানো ফিলটার বসানোর কাজ চলছে। প্রতিটি ন্যানো ঘণ্টায় এক হাজার লিটার সুপেয় পানি সরবারহ করতে পারবে। সেখানে ১৮টি পুকুর পুনরায় খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের আধার করা হচ্ছে এবং ৯৮৯টি রেইনওয়াটার হারবেস্টার রয়েছে। পানির সংকট দূর করতে হলে বড় আকারে বৃষ্টির পানির আধার তৈরি করা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই বলে তিনি জানান।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আম্পানের পর জেরিকেনের ম্যাধমে পানি সরবারহ করা হয়। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হয়েছে। ট্রাকসহ নানাভাবে সেখানে সুপেয় পানি সরবারহ করা হয়েছে। পানির সংকট নিরসন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে পানির উৎস নিশ্চিত করা হয়েছে।’