নওগাঁর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে এখন হলুদের ঢেউ। জেলার বিভিন্ন এলাকায় শর্ষে খেতে ফলন আসায় এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সরিষার এসব জমির পাশেই মৌ বাক্স বসিয়েছেন মৌচাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে সরিষার উৎপাদন বাড়ছে, অপর দিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। সমন্বিত এই চাষে কৃষক ও মৌচাষি উভয়েরই ভাগ্য বদলে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১টি উপজেলায় এ বছর ৬০ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত ৮ হাজার ৩০০টি মৌ বাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন ৮২ জন মৌচাষি।
নওগঁ সদর, রাণীনগর, আত্রাই, মান্দা, সাপাহার, ধামইরহাট, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় ৪ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমির শর্ষেখেতে এসব মৌ বাক্স স্থাপনা করা হয়েছে। ৮ হাজার ৩০০ মৌ বাক্স থেকে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৭০ হাজার কেজি (২৭০ মেট্রিক টন) মধু সংগ্রহ হবে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ। প্রতি কেজি মধুর ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এবার জেলায় সরিষার ফুল থেকে প্রায় ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ হতে পারে।
শর্ষেখেতে মৌখামার করে মধু চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ। নওগাঁর মান্দা উপজেলায় সবচেয়ে সরিষার আবাদ হয়েছে। এ উপজেলায় মৌখামারের সংখ্যাও বেশি। মান্দায় এ বছর ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিজুড়ে সমন্বিতভাবে সরিষা ও মৌচাষ হয়েছে। উপজেলার তেতুলিয়া, ভারশো, পরানপুর, কালিকাপুর ও ভালাইন ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠে শর্ষেখেতের পাশে ৫০ জন মৌচাষি মৌখামার করেছেন।
মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শায়লা শারমিন বলেন, সরিষাখেতে মৌমাছির আনাগোনা থাকলে সরিষার ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেশি বাড়ে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মৌমাছি সরিষার ফুলে যে পরাগায়ন ঘটায় তাতে সরিষার দানা ভালো হয় এবং ফলন বাড়ে। যে সরিষাখেতে মৌমাছি আনাগোনা থাকে না সেখানে ফলন কম হয়।
আরও পড়ুন: মাদারীপুরে সরিষার বাম্পার ফলন, লাভের প্রত্যাশা
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণে গত দুই-তিন বছর ধরে কৃষকেরা বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষার আবাদ করছেন। এছাড়া গত মৌসুমে সরিষার ভালো দাম পাওয়ার কারণেও এবার অনেক কৃষক সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়ানোর জন্য সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি বিভাগ নানাভাবে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। সরিষা চাষে আগ্রহী করে তুলতে এ বছর ৫৭ হাজার কৃষকের প্রত্যেককে এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষের জন্য বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ। চলতি মৌসুমে জেলায় উচ্চফলনশীল (উফশী) বারি-১৪, বারি-১৫ ও বারি-১৭ জাতের সরিষা আবাদ হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন কৃষকরা। এসব জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন।
সম্প্রতি জেলার মান্দা ও নওগাঁ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। কৃষকেরা যেমন মাঠে সরিষার পরিচর্যা করছেন, তেমনি খেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা।
গত বৃহস্পতিবার মান্দা উপজেলার তেতুলিয়া ইউনিয়নের সাটইল গ্রামের পাশে অবস্থিত একটি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষার চাষ হয়েছে। মাঠজুড়ে হলুদের সমারোহ। মাঠের পাশে একটি আমবাগানে ১৫০টি মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন মৌচাষি আবু বক্কর সুজন। পার্শ্ববর্তী পিরাকৈর মাঠে তার আরও একটি মৌখামার রয়েছে। ওই খামারে ১৫০টি মৌ বাক্স রয়েছে। সুজন ঠাকুরগাঁও থেকে এসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য।
আবু বক্কর সুজন বলেন, মৌখামারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি ১২ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছেন। ২০ দিন হলো তিনি সাটইল ও পিরাকৈর মাঠে মৌ বাক্স বসিয়েছেন। এ পর্যন্ত ৩০০টি বাক্স থেকে চার বার মধু সংগ্রহ করছেন। প্রতিবার একটি বাক্স থেকে ৭ থেকে ৮ কেজি মধু পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার কেজি সংগ্রহ করেছেন তিনি। আরও দুই সপ্তাহ এসব মাঠ থেকে মধু পাওয়া যায়। সরিষার খেতে ফুল কমে গেলে তিনি সংগ্রহের জন্য অন্য মাঠে চলে যাবেন।
আরও পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে সরিষার আবাদ বেশি হওয়ায় মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌয়ালরা
মৌচাষি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৪ দিন হলো তিনি ওই মাঠে মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স বসিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৪০০টি বাক্স থেকে দুই বার মধু সংগ্রহ করেছেন। প্রতিবার একটি বাক্স থেকে ৭ থেকে ৮ কেজি মধু পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ৫ হাজার ৮০০ কেজি মধু সংগ্রহ করেছেন তিনি। আরও তিন সপ্তাহ ওই মাঠ থেকে মধু পাওয়া যাবে। সরিষার খেতে ফুল কমে গেলে তিনি মধু সংগ্রহের জন্য অন্য মাঠে চলে যাবেন।
সাটইল গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রাজশাহীর তানোর উপজেলার এক মৌচাষির কাছ থেকে মৌখামারের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ৬ বছর ধরে নিজের সরিষাখেতের পাশে মৌবাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছি। গত বছর ১০০টি বাক্স থেকে ১৩ লাখ টাকার মধু বিক্রি করেছি। এবার মধুর দাম বেশি। ১০০টা বাক্স থেকে আশা করছি, এবার ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ হতে পারে। মৌসুমের সময় খামারে ৬ থেকে ৭ জন শ্রমিক কাজ করে। মধু নিষ্কাশন যন্ত্রের সাহায্যে মৌ বাক্সে স্থাপিত মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।’
মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ এবার ১৫ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। গত বছর ৫ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছিল।
আব্দুল মজিদ বলেন, ‘প্রতি বছর সাত থেকে আট বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়। সাধারণত অন্যান্য বছরগুলোতে মাঠের নিচু জমিগুলোতে ডিসেম্বর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পানি জমে থাকতো। তবে এবার বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নভেম্বরের আগেই নিচু জমিগুলা থেকে পানি নেমে গেছে। বোরো ধান লাগানোর আগ পর্যন্ত দুই-তিন মাস ১০ বিঘা নিচু জমি ফেলে না রেখে সেগুলোতেও সরিষার আবাদ করেছি। সরিষা গাছে ফুল ভালো এসেছে। আশা করছি, ফলনও ভালো পাবেন।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নওগাঁয় এ বছর ৬০ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব জমির পাশে রবিবার পর্যন্ত ৮ হাজার ৩০০ মৌ বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। বাক্সে থাকা মৌমাছি সরিষার ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করছে। এতে সরিষা ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে সরিষার ফলন বাড়ছে, অন্যদিকে অতিরিক্ত হিসেবে মধু পাচ্ছেন মৌচাষিরা। সমন্বিত চাষে কৃষক ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন। গত বছরও এ জেলায় সরিষাখেতের পাশে ৭ হাজার ৮০০ মৌ বাক্স বসেছিল। নওগাঁয় রবিশস্য সরিষার সঙ্গে মৌমাছি পালন করে মধু সংগ্রহ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন: ফরিদপুরে ১৫১.৩৮ কোটি টাকার সরিষার ফলনের প্রত্যাশা চাষিদের