দুই থেকে তিন ঘণ্টা ভারী বৃষ্টি হলেই ঢাকার সড়কগুলো যেন পরিণত হয় জলাশয়ে। দীর্ঘ সময়ের জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে। কোথাও হাঁটুপানি-কোথাও বা কোমর পানি মাড়িয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হয়। রাজধানীর বাসিন্দা হলেও অনেকের ঘর-বাড়িতে ঢুকে যায় বৃষ্টির পানি।
প্রায় চারদিকেই নদীবেষ্টিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন গত ৪-৫ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে হাতে নিয়েছে একাধিক মহাপরিকল্পনা। খাল ও ড্রেনেজ সিস্টেম সংস্কারে ব্যয় করেছে ৭৫০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু যার কোনো ইতিবাচক ফল দেখা যায়নি। বরং জলাবদ্ধতার মাত্রা বাড়ছে দিনকে দিন।
টানা কিছু সময় বৃষ্টি হলে শহরের বুকে জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয় অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থার বিপর্যয়। যানবাহনের অভাব, জলাবদ্ধ রাস্তায় গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া, বৃষ্টি ও পানির অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়াসহ নানা দুর্ভোগে নাজেহাল হতে হয় ঢাকাবাসীকে।
আরও পড়ুন: ভারী বৃষ্টিপাতে ঢাকায় জলাবদ্ধতা, ভোগান্তিতে যাত্রীরা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মূল সমস্যা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ না করা। বিশেষ করে যথাযথভাবে ড্রেনেজ, খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার না করায় এসব আটকে নালা ও ড্রেনেজ সিস্টেমে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। আর বিভিন্ন কার্যক্রমে সিটি করপোরেশন ও সরকারের অন্য সংস্থার মধ্যে তেমন সমন্বয়ও থাকে না। ফলে জলাবদ্ধতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেই বছরের পর বছর পার করছে সংস্থাগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করার পর তা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন কাজ শেষ হওয়ার পর তা আর রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে খাল ও ড্রেনের মুখ আবার ভরাট হয়ে যায়। তাই কাজ বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণ ও জবাবদিহি থাকা দরকার।’
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘আমরা নিজেরা নদী ও খালগুলো গলা টিপে হত্যা করেছি। প্রাকৃতিকভাবে আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিল খালগুলো। তা আমরা ভরাট করেছি বক্স কালভার্ট বানিয়ে। এখন আবার খাল উদ্ধার নামে নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে টাকার অংক বাড়ালেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) জানায়, বিভিন্ন সময় খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার বাবদ প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি বাজেটে ড্রেনেজ সংস্কার ও ময়লা পরিস্কারে আরও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও সমাধান হয়নি জলাবদ্ধতার। সর্বোচ্চ ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তা দ্রুত সময়ে নিষ্কাশন করার সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু এর বেশি বৃষ্টি হলে নিরুপায় সিটি করপোরেশন।
আরও পড়ুন: ভারী বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির ৫ হাজারের বেশি পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ১০ কিউআরটি
পানি নিরসনে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তারপরও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে। খরচের মধ্যে খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর।
ডিএসসিসি কর্মকর্তারা জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এমন ১৩৬টি পয়েন্টের মধ্যে ১০৪টি পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির খালগুলো সংস্কারের মাধ্যমে পানি প্রবাহ সৃষ্টি করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্ষা মৌসুমের আগেই ড্রেনেজ পরিষ্কার করা হয়। তারপরও বেশি সময় ধরে বৃষ্টি হলে জলাববদ্ধতা তৈরি হয়। এর মধ্যে অনেক স্থানে ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করেই জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে। এছাড়াও জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক পয়েন্টের কাজ শেষ হলে আবার নতুন পয়েন্ট যুক্ত হয়। তাই ঢাকার খালগুলো সচল না হলে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্প নেই। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নের খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু খরচ হয়েছে আরও কিছু বাকি আছে।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চারটি খালের সৌন্দর্যবর্ধনে ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন পায়। ৮৯৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুনে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা দক্ষিণের জলাবদ্ধতা অনেকটাই নিরসন হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: স্পঞ্জ সিটি: ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বন্যা-জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান