করোনার দীর্ঘ ছুটি শেষে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো৷ এরই ধারাবাহিকতায় খুলে যাচ্ছে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও ক্যাম্পাসে আর ফিরবেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী তোরাবি বিনতে হক, একই বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের আছিয়া আকতার, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের তৌহিদুল আলম প্রত্যয় ও রসায়ন বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ। তোরাবি বিনতে হক, আছিয়া আকতার, তৌহিদুল আলম প্রত্যয় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা এবং সাব্বির আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
তাই ক্যাম্পাস খুললেও সহপাঠীদের আর বসা হবে না তাদের সাথে। করা হবে না খুনসুটি, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দুষ্টুমি।
মৃত তোরাবি বিনতে হক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১৮-১৯ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি নেত্রোকোণা জেলার চল্লিশা ইউনিয়নের মোগরাটিয়া গ্রামে। ২০২০ সালের ৬ আগস্ট নেত্রকোণা পৌরসভার কাটলি এলাকায় নিজকক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। সেসময় পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় পড়াশোনা নিয়ে কথা বলায় মন খারাপ করে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তোরাবি।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ও তোরাবি বিনতে হকের সহপাঠী জিষ্ণু চক্রবর্তী বলেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল ও উদার মনের বন্ধু তোরাবির অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য সত্যিই বেদনাদায়ক। কোনো শিক্ষার্থীরই এভাবে অকালে চলে যাওয়া কারো কাম্য নয়৷ সকলের পদচারণায় ক্যাম্পাস মুখরিত হলেও তোরাবিকে আমাদের বারবার মনে পড়বে, তার শূণ্যতা আমাদের স্মৃতিকাতর করে তুলবে।
আরও পড়ুন: দেড় বছর পর হলে ফিরলেন শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা
বাংলা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আছিয়া আকতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ বর্ষের ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ দেখার সুযোগ হয়েছিল মাত্র দেড়মাস। এরই মধ্যে শুরু হয় করোনাকালীন শিক্ষাছুটি। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর তোরাবির মতো আছিয়া আকতারও গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন নিজ বাড়িতেই।
তার বাড়ি বগুড়া সদরের নামুজা ইউনিয়নের মথুরা গ্রামে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, মেয়েটির নিজ এলাকায় সম্পর্ক ছিল। আর এই সম্পর্কের জের ধরেই ২০২০ সালের ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ফজর নামাজের আগে ঘরের বারান্দায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আছিয়া আকতারের সহপাঠী বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা আকতার জানান, প্রতিটি মৃত্যুই অপ্রত্যাশিত। আর তা যদি সদা হাস্যোজ্বল কোনো বন্ধুর আত্মহত্যা হয় তাহলে সে কষ্টের পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব। আত্মার সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। একটি ব্যাচে কিংবা একটি শিক্ষাঙ্গনে আমরা সবাই একে অপরের সাথে এক গভীর মমত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আর এই বন্ধন থেকে সদা চঞ্চল, মিষ্টভাষী, প্রিয়মুখ আছিয়া যখন নিয়তির নির্মম পরিহাসে ছিন্ন হয়ে গেলো তখন শত শত মানুষের পদচারণায় চারপাশ মুখরিত থাকলেও আছিয়ার অভাব, তার অনুপস্থিতি আমাদের প্রত্যেকের অন্তরকে করে তুলবে গভীরভাবে স্মৃতিকাতর ও শোকাবহ।
তিনি বলেন, তার এই অকাল প্রয়াণ আমাদের মধ্যে যে গভীর শূন্যতা তৈরি করেছে তা আর কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। জীবনের চরম অসহায় অবস্থাতেও যেন আমরা হাল না ছেড়ে দিই, আর কোনো আছিয়াকে যেন আমাদের হারাতে না হয়, এটাই আমাদের কাম্য।
এদিকে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের তৌহিদুল আলম প্রত্যয়। মৃত তৌহিদুল আলম প্রত্যয় মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার এস.এম জাহিদুল আলমের সন্তান। জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালের সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী নতুনবাজার এলাকার স্বপ্নীল সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলার একটি মেসের ৬ নম্বর কক্ষে জানালার গ্রিলের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে প্রত্যয়ের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। পরবর্তীতে প্রক্টরিয়ালবডির উপস্থিতিতে মৃত প্রত্যয়ের লাশ জালালাবাদ থানা পুলিশ উদ্ধার করে।
এছাড়াও চলতি বছরের ৫ মে রসায়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সিলেট নগরীর সুবিদবাজার পয়েন্টে মোটরসাইকেলযোগে আসামাত্র পেছন থেকে একটি ট্রাক তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এ সময় সাব্বির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেলসহ নিয়ে নিচে পড়ে যান। এতে মাথায় গুরুতর আঘাতের ফলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
শাবিপ্রবি প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড.আলমগীর কবীর বলেন, এই অসময়ে আমাদের এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা চলে যাবে তা আমাদের খুবই মর্মাহত করে। তবে এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান থাকবে ভবিষ্যতে এইধরনের দুর্ঘটনা যাতে না হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সর্বত্র শিক্ষার্থীদের পাশে আছি। শিক্ষার্থীদের মানসিকসহ যে কোনো সমস্যা, পরামর্শ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমাদের দরজা সবসময় খোলা।
আরও পড়ুন: গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় নতুন ইতিহাস তৈরি হল: শাবিপ্রবি উপাচার্য
শাবিপ্রবিকে ‘শতভাগ ডিজিটাল’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করব: উপাচার্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহীর উদ্দিন আহমদ বলেন, খুবই মর্মাহত হই যে, এই সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীরা অকালে ঝড়ে গেছে। যারা একদিন দেশের নেতৃত্ব দেবে, তারা এভাবে ঝরে যাবে তা মানতে কষ্টকর। আমরা চাই না আর কোনো সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা কোনো এরূপ ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুক।
তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন দীর্ঘ ছুটি শেষে বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন রকম সমস্যায় পড়বেই। শিক্ষার্থীরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরাসরি আমাদের কাছে চলে আসার আহ্বান জানাবো। আমাদের ছাত্র কল্যাণ উপদেষ্টার অধীনে কাউন্সিলিং সাইকোলজিস্ট আছেন। যেকোনো মানসিক সমস্যায় সর্বত্র সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হবে শিক্ষার্থীদের প্রতি। আমরা চাই প্রতিটা শিক্ষার্থী মানসিক সুস্থতার মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন পার করে তাদের ভবিষ্যত জীবনেও সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক।
উল্লেখ্য, এই চার শিক্ষার্থী ছাড়াও চলতি বছরের ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ বর্ষের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আলমগীর কবির সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেন এবং ১৬ অক্টোবর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান দেশের বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়াশোনা করতে গিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনাগুলো শাবিপ্রবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে হৃদয় বিদারক পরিবেশ তৈরি করেছে।