কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ রেল জংশনের রেলওয়ের হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রভাবশালীরা মার্কেট নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাসদের স্থানীয় কয়েকজন নেতা একজোট হয়ে এই মার্কেট গড়ে তুলেছেন। তাই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলছেন না। যাদের সরব থাকার কথা রহস্যজনকভাবে তারাও চুপ হয়ে আছেন।
প্রায় দশ বছর আগে রেলওয়ের হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে পাকা একতলা মার্কেট নির্মাণ করা হলেও সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় দশ বছর ধরে ধীরে ধীরে রেলওয়ের সরকারি কোটি কোটি টাকার মূল্যের সম্পত্তি দখল করে সেখানে ৮০টির বেশি পাকা দোকান নির্মাণ করে প্রভাবশালী এই চক্রটি। কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করেই এই মার্কেট নির্মাণ করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া আদায় করে আসছে তারা। নিয়মিত মাসোহারা পাওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন হচ্ছে পোড়াদহ রেলস্টেশন। বৃটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়ার জাগতি পর্যন্ত প্রথম রেলপথ স্থাপিত হয়। পরে ১৮৭৮ সালের মধ্যে পোড়াদহ থেকে ভেড়ামারা রেলপথ চালু হলে পোড়াদহ রেলওয়ে জংশনে পরিণত হয়। সে সময় সেখানে রেলওয়ে হাসপাতাল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য কোয়ার্টার, ফসল উৎপাদনের মাঠ, ডোবা এমনকি গোরস্থান পর্যন্ত তৈরি করা হয়। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের এই হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা পেত রেলওয়ের স্টাফসহ আশপাশের মানুষ। হাসপাতালের সাথেই ছিল বিশাল মাঠ। পরবর্তীতে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে হাসপাতালটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: নাঙ্গলকোট রেলওয়ে স্টেশন: দুই হাজার যাত্রীর বিপরীতে ৮০টি আসন!
এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগসাজশে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রেলওয়ের স্থানীয় ঠিকাদার আশরাফুল কবির রিন্টু টেন্ডারের মাধ্যমে প্রথমে হাসপাতালের পরিত্যক্ত ভবনটি ভেঙে ফেলেন। এর কিছুদিন পর হাসপাতাল ভবনের জায়গায় একতলা বিশিষ্ট ৪৪টি পাকা দোকান নির্মাণ করা হয়। দিন যত গড়িয়েছে মার্কেটে দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। দখল করা হয়েছে হাসপাতালের বিশাল মাঠটিও। হাসপাতাল ভবন এবং মাঠের জায়গা সব মিলিয়ে বর্তমানে দোকানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৪টি।
এলাকাবাসী জানায়, ১৯৯৯ সালের দিকে রেলওয়ে জংশন পোড়াদহ স্টেশন রেলওয়ে হাসপাতাল ভবনের পাশেই প্রভাবশালী চক্রটি জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে শহীদ তারেক বীর বিক্রম স্মৃতি সংঘ (অনিবন্ধিত) নামে একটি ক্লাব গড়ে তোলে। ২০০৪ সালে চক্রটি হাসপাতাল মাঠ দখল করে ৪৪টি পাকা দোকান নির্মাণ করে। প্রতিটি দোকান ৪-৬ লাখ টাকার বিনিময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। একই সাথে সেখানে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে।
সরেজমিনে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ইউএনবির এ প্রতিনিধি জানতে পেরেছেন, পোড়াদহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোশারফ হোসেন, পোড়াদহ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাসদ নেতা ফারুকুজ্জামান জন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রাহাত, যুবলীগ নেতা পারভেজ, পোড়াদহ বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাবেক বিএনপি নেতা মুন্না ও রেলওয়ের স্থানীয় ঠিকাদার আশরাফুল কবির রিন্টুসহ কয়েকজন এই মার্কেট নির্মাণ করেন এবং মোটা অংকের টাকায় অন্যদের কাছে দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রাহাতের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন স্থানীয় বিএনপি নেতারা হাসপাতালের মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন। পরবর্তীতে ক্ষমতার পালা বদল হলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগের নেতারা সেখানে মার্কেট নির্মাণ করে।’
আরও পড়ুন: কোরিয়া থেকে ১৫০টি মিটারগেজ কোচ কিনছে রেলওয়ে
এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে অফিসের বিভাগীয় প্রকৌশলী বীরবল মণ্ডলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তার এখতিয়ারে নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।’
পাকশী রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের ফিল্ড কানুনগো রাজিবুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘এগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের। আর তাছাড়া আমি অল্প কিছুদিন হলো এখানে যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আমাদের যথেষ্ট লোকবল সংকট রয়েছে। যে কারণে চাইলেই আমরা সব সময় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি না।’ বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি।
আরও পড়ুন: ডিপো থেকে তেল চুরি: রেলওয়ের প্রকৌশলী গ্রেপ্তার
পাকশী রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. নূরুজ্জামান জানান, এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা (পশ্চিম) ডা. সুজিত কুমার রায় বলেন, ‘১৯৯২-৯৩ সালের দিকে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে ছাঁটাই করে ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রাখে। সেই সময় পোড়াদহ রেলওয়ে হাসপাতালের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক যোগে ক্লোজ করে নেয়া হয়। কারা কীভাবে হাসপাতাল দখল করেছে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’