বাগেরহাটে এবছর আমন ধানের ফলন ভাল হয়েছে। ধানের ফলনে লবণাক্ত এই অঞ্চলের চাষিরা খুশি। ফলন ভাল হলেও চলতি মৌসুমে বাগেরহাটের চাষিরা খাদ্যগুদামে আমন ধান বিক্রি করতে নিয়ে আসেনি। ফলে এবছর বাগেরহাট জেলায় এখনও পর্যন্ত এক ছটাক পরিমাণও আমন ধান সংগ্রহ হয়নি।
হাট-বাজারের চেয়ে সরকার নির্ধারিত সংগ্রহের মূল্যে মণ প্রতি প্রায় ১০০ টাকা কম ছিল। একারণে চাষিরা খাদ্য বিভাগের কাছে ধান বিক্রি করেনি।
এছাড়া সিন্ডিকেট এবং নানা ধরণের নিয়ম কানুনের কারণে চাষিরা খাদ্য বিভাগের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তবে চাল লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯২ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে বলে খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে।
চাষিরা বলছেন, সরকারিভাবে চাষিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সহজে ধান কেনা উচিত। সেই সঙ্গে হাট-বাজারের চেয়ে সরকারি সংগ্রহ মূল্যে বেশি থাকতে হবে।
খাদ্য বিভাগ বলছে, শেষ সময় আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাগেরহাটে আমন ধান সংগ্রহ হওয়ার আর সম্ভবনা নেই। হাট-বাজারের চেয়ে সরকারি মূল্যে কম থাকায় এখনও পর্যন্ত এক ছটাক পরিমাণও আমন ধান ঢোকেনি সরকারি গুদামে।
আরও পড়ুন: ঐতিহ্যের তালপাখা, ব্যস্ত বাগেরহাটের কারিগররা
জানা গেছে, সরকার অভ্যন্তরীণ আমন সংগ্রহ ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই মৌসুমে আমন ধান-চাল সংগ্রহ চলবে। বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলা থেকে তিন হাজার ৯০২ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সরকারিভাবে সংগ্রহের মূল্যে প্রতিমণ ধান ১ হাজার ৩২০ টাকা। কিন্তু, হাট-বাজারে ধান ১ হাজার ৪০০ থেকে, ১ হাজার ৪২০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলায় এক ছটাকও ধান সংগ্রহ হয়নি।
জেলা খাদ্য বিভাগের তথ্য মতে, সরকারিভাবে বাগেরহাট সদরে ৪০৯ টন, মোড়েলগঞ্জে ১১৩৯ টন, রামপালে ৫০৫ টন,শরণখোলায় ৪৭৮ টন, মোংলায় ১৬০ টন, ফকিরহাটে ২৮৪ টন, মোল্লাহাটে ২০৭ টন, কচুয়ায় ৩৩৭ টন এবং চিতলমারী উপজেলায় ৩৮৩ টন ধান সংগহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া জেলার ৯টি উপজেলা থেকে ৩ হাজার ৩০৪ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরই মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ পরিমাণ চাল সংগ্রহ হয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের সাইফুর রহমান নাথু জানান, তার প্রায় ২০ বিঘা ধানের জমি রয়েছে। তাদের জমিতে আমন এবং বোরো ধানের চাষ হয়। গত মৌসুমে সরকারি গুদামে আমন ধান বিক্রির জন্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, নিয়ম কানুন আর নানা কারণে শেষ পর্যন্ত সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে পারেনি। একারণে এই মৌসুমে তিনি সরকারি গুদামে ধান বিক্রির চেষ্টা করেনি।
ফতেপুর গ্রামের তরুন কুমার পাল জানান, এবছর সে চার বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছে। বিঘা প্রতি ৩০ মন করে ১২০ মন ধান ফলেছে। ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ধানে আদ্রতা একটু বেশি এবং চিটা থাকলে সরকারি গুদামে ধান নিতে চায় না। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে দৌড় ঝাপ করতে হয় বলে সে জানতে পেরেছে। আর এবছর হাট-বাজারে ধানের মূল্যে বেশি ছিল। সে কারণে তিনি সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে আগ্রহী না।
বাগেরহাট সদরের বারুইপাড়া গ্রামের শেখ মুহাম্মদ মিজান জানান, দুই বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছে। ধান মারাই করার পর বাড়ি থেকে ব্যাপারী এসে ধান ক্রয় করে নিয়ে গেছে। সরকারিভাবে ধান ক্রয় করা হয় এমন খবর তিনি জানেন না।
আরও পড়ুন: রপ্তানিতে আশা জেগেছে বাগেরহাটের চাষিদের, টমেটো যাচ্ছে মালয়েশিয়ায়
বাগেরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) শাকিল আহমেদ জানান, সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষি কার্ড অথবা আইডি কার্ড থাকতে হবে। এর পর কৃষি বিভাগ থেকে অনুমোদন দেওয়ার পর কৃষকরা জনপ্রতি ১২০ কেজি থেকে ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত ধান গুদামে নিয়ে আসতে পারবেন। ধানের আদ্রতা ১৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার প্রতিমণ আমন ধান সংগ্রহের মূল্যে ১ হাজার ৩২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। চাষিদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হলে টাকা সরাসরি তাদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা দেওয়া হবে।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) শাকিল আহমেদ আরও জানান, জেলায় ৩ হাজার ৯০২ টন আমন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত জেলায় এক ছটাকও ধান সংগ্রহ হয়নি। ধান সংগ্রহের সময় প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামি ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমন ধান সংগ্রহ চলবে। এই সময়ের মধ্যে ধান সংগ্রহ হওয়ার সম্ভবনা নেই। তবে চাল লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯২ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে বলে তিনি জানান।
এক ছটাকও আমন ধান সংগ্রহ না হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শাকিল আহমেদ জানান, হাট-বাজারের তুলনায় সরকার নির্ধারিত সংগ্রহের মূল্য কম হওয়ায় কারণে চাষিরা ধান বিক্রি করার জন্য তাদের কাছে আসছেন না। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি হওয়ার কারণে এ অঞ্চলের অধিকাংশ ধান উত্তরাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে নিয়েছে। ফলে ধানের স্বাভাবিক সহজলভ্যতা ছিল না।
হাট-বাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান ক্রয়ের পরামর্শ দিলেন ওই খাদ্য কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন: বাগেরহাটে ১২শ’ পাখি উদ্ধার, ফিরল আপন ঠিকানায়
বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার জানান, জেলায় এবছর ৭৩ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়। মোট দুই লাখ ৭৭ হাজার ৮০০ টন ধান উৎপাদন হয়েছে। জেলায় মোট ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৮ জন কৃষক পরিবার রয়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৪৭ হাজার আমন ধান চাষি রয়েছেন। এবছর জেলায় আমন ধানের ফল ভাল হয়েছে। চাষিদের কাছ থেকে আরও সহজে ধান ক্রয়ের পরামর্শ দিলেন কৃষি কর্মকর্তা।