খুলনার কর্মজীবী নারীদের ঘরে নেই ঈদ আনন্দ। অনেকে হারিয়েছেন কাজ। কারো-কারো সংসার চলছে ঋণে। এমন পরিস্থিতিতে মহিলাদের ক্ষেত্রে সংসার চালানো হয়ে গেছে কষ্টকর। পাচ্ছেন না সরকারি ও বেসরকারি অনুদান। আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরের আনন্দ নেই তাদের ঘরে।
নগরীর টুটপাড়া আমতলা মোড়ের ভাড়া বাসার বাসিন্দা দর্জি মালেকা বেগম জানান, তার স্বামী খোকন হাওলাদার ১৩ বছর আগেই দুই সন্তান ও স্ত্রীকে ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর থেকেই সংগ্রামী জীবন শুরু হয় মালেকা বেগমের। দুই ছেলেকে বড় করতে মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু লকডাউনে তার কাজ চলে যায়। একটি লেডিস টেইলার্সে দর্জির কাজ করে কোনও রকম সংসার চলে মালেকার। লকডাউন ও রমজানে কাজের চাপও কম। বড় ছেলে ইয়ামির হাওলাদার রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও এখন কাজ তেমন নেই। ছোট ছেলে আজমাইন হাওলাদার নগরীর একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কাজ করতো, কিন্তু লকডাউনে তারও চাকরি চলে গেছে। সব মিলিয়ে দুর্বিষহ জীবন চলছে মালেকার পরিবারের।
আরও পড়ুন: খুলনার বেসরকারি ১৭ পাটকল বন্ধ হওয়ার উপক্রম
স্থানীয় কোন জনপ্রতিনিধি বা সরকারিভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা পায়নি পরিবারটি। ঘর ভাড়া ও খাওয়ার খরচ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সামনে ঈদ। কি করবে তা নিয়ে প্রতিটা সময় দুঃশ্চিন্তা মালেকার চোখে।
মালেকা জানান, বাড়ির কাজ থাকলে ভাত তরকারি পেতাম। যা দিয়ে দুই ছেলেকে খাওয়াতাম। কিন্তু কাজ না থাকায় খুবই সমস্যায় আছি। দর্জির কাজ করেও কিছু করতে পারছি না। দুই ছেলেরও কাজ নেই। গরীবের লকডাউনের কারণে কত সমস্যা হচ্ছে তার খবর কেউ রাখে না।
নগরীর রেল কলোনীর চা বিক্রেতা আকলিমা বেগম জানান, তার স্বামী সবুজ হাওলাদের সাথে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর নিজেই সংসারের হাল ধরেন। প্রথমে বাড়িতে রান্না করে বিভিন্ন দোকান ও অফিসে খাবার সরবরাহ করতেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেই কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। এদিকে তিন ছেলে মেয়েকেই লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। বড় ছেলে আকাশ হাওলাদার ১০ম শ্রেণিতে, মেয়ে সুরাইয়া আক্তার ৯ম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে হাসান ৪র্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। সংসার ও ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে খুলনা কোর্টের সামনে অস্থায়ীভাবে একটি চায়ের দোকান দেন আকলিমা। কিন্তু লকডাউনের কারণে সেখানেও মন্দা। এরপর আবার রমজান। সব মিলিয়ে কেনা-বেচা নেই বললেই চলে। সন্ধ্যার পরপরই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। যার ফলে যা বিকিকিনি হয় তা দিয়ে কিছু হয় না।
আরও পড়ুন: করোনা উপেক্ষা করে খুলনায় জমজমাট ঈদ কেনাকাটা
আকলিমা বলেন, ‘লকডাউনের কারণে পেশা বদল করলাম। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। রমজান ও লকডাউন একত্রে আসায় সব শেষ হয়ে গেছে। মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এখন চলা লাগছে। ঈদে আল্লাহ যেভাবে কাটাবেন সেভাবে কাটবে।’
তিনি আরও বলেন, সবাই শুধু আশ্বাসই দেয়। কিন্তু কেউ এখন পর্যন্ত কোনও সহযোগিতা করেনি।
নগরীতে ফেরী করে পানি বিক্রি করেন জহুরা খাতুন।
তিনি জানান, দোকানপাট বন্ধ লকডাউনে। যার ফলে কাজ নেই অধিকাংশ মানুষের। দোকানে দোকানে পানি বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চলতো আমার। এক কলস পানি দিলে ৫ টাকা পেতাম। সারা দিন শহরে কাজ করেই রাতে চলে যাই জেলখানা ঘাটের ওপারের তেরখাদা উপজেলায়। মূলত ডিসি অফিস, আদালত পাড়া ও স্টেডিয়াম এলাকার চায়ের দোকান ও হোটেলে পানি বিক্রি করেই চলত আমার সংসার। লকডাউনে কাজ নেই। চায়ের দোকান দু’একটা খুললেও রমজানে পানির চাহিদা কম। যার ফলে সংসার চলছে কোন রকমে।
স্বামী আজিজ গাজী দিন মজুরের কাজ করে। কিন্তু তারও এখন কাজ নেই। সব মিলিয়ে খুবই বিপদের মধ্যে আছি। সংসারে চার ছেলে মেয়ে। বড় ছেলে ওবায়দুল হাফেজি পড়ালেখা করে, মেয়ে আছিয়া খাতুন এবার এইচএসসি পাস করেছে। হাসান ও ফাইজান নামে দুই ছেলে ঘরে। ছয় জনের সংসার ও লেখাপড়ার খরচ এখনও উঠে না। যার কারণে সংসার কি করে চলছে একমাত্র আল্লাহই ভাল জানে। গরীবের দিনই যাচ্ছে কোন রকম আর ঈদ দিয়ে কোন প্রস্তুতিই নেই।
আরও পড়ুন: খুলনাঞ্চলে যেসব কারণে বোরোর আশানুরূপ ফলন হয়নি
তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতাও পাচ্ছি না। আমাদের বাড়ি তেরখাদায়। কিন্তু কাজ করি সারাদিন শহরে। যার ফলে কারও কাছে সহযোগিতা চাইলে বলে যেখানে থাকেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা দিবেন। এইভাবে করে কোনও সহযোগিতা এখনও পর্যন্ত পাননি তিনি।