আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রশাসনে যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছিল, তার মধ্যেই নতুন করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে একাধিক সংগঠন। সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে চলছে মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, কর্মবিরতি ও আল্টিমেটাম। এতে করে প্রশাসনের প্রাত্যহিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয়ে একপ্রকার অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
গত আগস্ট থেকেই প্রশাসনে যে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়, তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, বিতর্কিত আমলাদের অপসারণ, সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ বাতিল, অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রত্যাহারসহ নানা দাবিতে আন্দোলন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারাও বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের ফের অবরুদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ডিসি নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল।
গত কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিছিল করছেন, অবস্থান নিচ্ছেন। আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারাও, মানববন্ধন করে কর্মবিরতির আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।
বিক্ষোভের কেন্দ্রে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদন বাতিল ও প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ।
শনিবার (২৪ মে) সকাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ অধ্যাদেশের বিরোধিতা করে সচিবালয়ে মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। কর্মকর্তারা এ অধ্যাদেশকে ‘নিবর্তনমূলক ও কালাকানুন’ আখ্যায়িত করে অধ্যাদেশ থেকে অসঙ্গতিপূর্ণ ধারা বাতিলের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে অনুরোধ জানান।
আরও পড়ুন: অধ্যাদেশ সংশোধনের আশ্বাসে এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার
গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য চারজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর ইউএনবিকে বলেন, এই অধ্যাদেশে এমন কিছু ধারা রয়েছে, যা সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই শাস্তি বা চাকরিচ্যুতির পথ খুলে দিয়েছে। অধ্যাদেশের খসড়াটিকে ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ আখ্যায়িত করে তা পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছি আমরা।
তিনি আরও বলেন, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-তে সব আচরণবিধি ও অন্যান্য বিধান বিবৃত আছে। এখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘নিবর্তনমূলক’ ধারা সংযোজন করা হচ্ছে। এটি একটি কালাকানুন। আমরা দ্রুত সময়ে এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার চাই।
২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে অধ্যাদেশের যে খসড়া নিয়ে সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ, তাতে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কর্মে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানির জন্য কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এর প্রতিবাদে গতকালও (রবিবার) সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এ সময়ে অধ্যাদেশটি বাতিল না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
বৈষম্যবিরোধী ফোরামের কর্মসূচি
এদিকে, আওয়ামী দোসর হিসেবে চিহ্নিত আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে ‘বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’।
সংগঠনটির সদস্য সচিব কাজী মেরাজ হোসেনের দাবি, ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ও লুটেরা ওইসব কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে। জনপ্রশাসন সচিবসহ চুক্তিভিত্তিক কাজে নিয়োজিত সবার চুক্তি বাতিল করতে হবে।
আরও পড়ুন: রাজস্ব সংস্কারে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের দাবি ঐক্য পরিষদের
তিনি বলেন, উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণের অনুরোধ জানিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে বারবার আশ্বাস দিলেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
এমন বাস্তবতায় বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে রবিবার (২৫ মে) সকাল ১০টায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশান মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে সংগঠনটি।
এর আগে, গত ১৩ মে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক সচিব আবদুল খালেকের নেতৃত্বে ৩৫-৪০ জন কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দপ্তরে সামনে অবস্থান নেন। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এরফানুল হককে সারা দিন অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, সে সময় উপসচিব জামিলা শবনমকেও হেনস্তা করা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়।
তার আগে, আওয়ামী লীগ আমলে নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে অবরুদ্ধ করেছিলেন।
এনবিআর বিলুপ্তি নিয়ে উত্তেজনা
গত ১২ মে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ জারি করে। এর প্রতিবাদে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা ধারাবাহিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জারিকৃত অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ওয়েবসাইটে প্রকাশের দাবি জানিয়েছে আসছেন।
আরও পড়ুন: সরকারি কর্মচারী অধ্যাদেশ বাতিল দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভ
এর মধ্যে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বৈঠকের পরও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। গত ২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, সরকার আপাতত এনবিআরকে ভাগ করছে না। তবে আন্দোলনকারীরা এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে।
২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের কলমবিরতির ডাক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈষম্য নিরসনে ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে তারা ‘ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার’, উন্মুক্ত নিয়োগ পরীক্ষা এবং পদোন্নতিতে সমান সুযোগের দাবি জানিয়ে আসছেন। ইতোমধ্যে কলমবিরতি, মানবন্ধন, সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। তবে দাবি না মানলে তারা আরও কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
জনপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সচিবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বর্তমানে কর্মরত পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ৪৪ জন সচিব ও ৯৫ জন ম্যাজিস্ট্রেটের তালিকা প্রকাশ করেছে জুলাই ঐক্য নামের একটি সংগঠন।
সংগঠনটি এসব আমলা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসহ সাত দফা দাবি জানিয়েছে। ৩১ মের মধ্যে দাবি মানা না হলে ‘মার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, জুলাই ঐক্যের প্রকাশিত ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের এই তালিকা নিয়ে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে সরকারের শীর্ষ মহল। এ ব্যাপারে মোখলেস উর রহমানের ভূমিকা নিয়ে সরকারের ভেতরের মহলে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে প্রতিনিয়ত অস্থিরতা বাড়ছে। বিভিন্ন দাবির কারণে জনপ্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জনপ্রশাসন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের নেতৃত্বে দুর্বলতা এবং অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে পরিস্থিতির দ্রুত সমাধান না হলে প্রশাসনে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
আরও পড়ুন: সরকারি চাকরি আইনের সংশোধনী অধ্যাদেশের খসড়া বাতিলের দাবি, কর্মকর্তাদের বিক্ষোভ
এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান ইউএনবিকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নেতৃত্ব-দুর্বলতার কারণে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সরকার। এ কারণেই প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’ যিনি যেখানে অভিজ্ঞ, তাকে সেখানে পদায়ন করতে বলে মনে করেন তিনি।
সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, ‘এত দিন পরও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা (অন্তর্বর্তীকালীন) সরকারের চরম ব্যর্থতা। সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই প্রশাসনে দক্ষ লোক বসানো। হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিলে অনেক দাবি সমাধান হয়ে যেত।’