ইউএনবির সাথে সম্প্রতি আলাপকালে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার বিশাল সম্ভাবনা দেখছি...অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন ও জোরদার করতে চাই।’
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়াও দুই সরকার ও ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কও অনেক ভালো বলে জানান তিনি।
ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ একই ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভিয়েতনাম ২০৪৫ সালের মধ্যে এবং বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। আমরা লক্ষ্যমাত্রা এবং ভবিষ্যতে একই ধরনের উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে আছি।’
বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য জোরদার
ভিয়েতনাম দূতাবাসের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক এখনও কম হলেও ইতিবাচকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে ভিয়েতনামের রপ্তানি করা পণ্যগুলোর মধ্যে মূলত বস্ত্র, প্লাস্টিক পণ্য, বেত পণ্য, বাঁশজাতীয় পণ্য, সামুদ্রিত ঘাসের গালিচা, রাবার, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক পণ্য, কাঠের পণ্য, সিরামিক এবং চীনামাটির বাসন রয়েছে।
অন্যদিকে, ভিয়েতনামে বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে তার মধ্যে ওষুধ, কাপড়, বস্ত্রের কাঁচামাল, চামড়া, বিভিন্ন ধরনের ফাইবার, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক উপাদান এবং সার রয়েছে।
‘বাংলাদেশে এসে ব্যবসা করতে ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেই সাথে আমি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভিয়েতনামে ব্যবসা পরিচালনা ও আয়ের সুযোগ খুঁজে নিতে আমন্ত্রণ জানাতে চাই,’ বলেন রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন।
আরও পড়ুন: মানুষে-মানুষে বন্ধন বাড়িয়ে তুলতে পারে শিল্প: ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত
দুদেশের যৌথ বাণিজ্য কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। যেখানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ কীভাবে এক বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া সে লক্ষ্যে আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং ১১টি অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র চিহ্নিতও করেছিল। যার মধ্যে ছিল কৃষি বাণিজ্য এবং বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামে ওষুধ রপ্তানি।
‘আমি ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের এখানে আসতে উৎসাহিত করি কারণ আমি একসাথে ব্যবসা করার অনেক সম্ভাবনা দেখছি,’ বলেন তিনি।
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম সহযোগিতা
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বলেন, কৃষিকে সহযোগিতার অন্যতম সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসেবে দেখছেন তিনি। ‘আমি মনে করি কৃষি ক্ষেত্র এবং কৃষি উত্পাদন উন্নয়নে সহযোগিতা করার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।’
ভিয়েতনামের কাজুবাদাম সমিতি বলছে, ২০১৭ সাল থেকে ভিয়েতনাম কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রপ্তানিতে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। তারা বিশ্বে কাঁচা কাজুর ৫০ শতাংশের বেশি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকে। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও ভিয়েতনাম গত বছরের প্রথম ১০ মাসে চার লাখ ২২ হাজার টন কাজু রপ্তানি করেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় এক হাজার ৩২৩ টন কাজু উত্পাদন করেছে। তবে দেশে কাজুর চাহিদা আনুমানিক ৫০ হাজার টন। এ জন্য দেশকে কাজু আমদানির ওপর প্রচুর পরিমাণে নির্ভর করতে হয়।
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কাজু চাষের বিষয়ে তিনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব পেয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারি। এই ক্ষেত্রে আমরা উন্নয়নের ধারণা, অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করতে পারি।’
জনশক্তি প্রশিক্ষণ
জনবলকে সহযোগিতার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে উল্লোখ করেন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘জনবলের দিক থেকে ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ একই অবস্থানে আছে। দেশ উন্মুক্ত এবং বাজারও তাই। আমাদের ভিয়েতনামের লোকদের বিদেশে কাজ করতে পাঠানোর জন্য বাজার প্রয়োজন এবং বাংলাদেশেরও জনশক্তি রপ্তানির বাজার প্রয়োজন।’
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বলেন, ‘জনশক্তির চলাচল দ্বি-মুখী। আমাদের নতুন কৌশল ও দক্ষতা দরকার এবং আমি মনে করি প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করার বড় সম্ভাবনা রয়েছে।’
কোভিড-১৯: সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
সফলভাবে যেসব দেশ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করেছে এমন দেশগুলোর একটি হলো ভিয়েতনাম। দেশটির ট্রেসিং, টেস্টিং এবং চিকিত্সা নীতিমালার কারণে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনায় মাত্র ৩৫ জনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৯১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার ১৮২ এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৫ জনে পৌঁছেছে। দেশের জনগণকে এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেয়া হচ্ছে এবং পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতির দিকে যাবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বাংলাদেশের করোনা মোকাবিলায় নেয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন।
তিনি বলে, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশ ভালো করেছে। এখন আক্রান্তের সংখ্যা কমছে এবং অর্থনীতি ভালো করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশটি করোনাভাইরাস মোকাবিলার ক্ষেত্রে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রশংসা করে তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ ও তার জনগণের প্রশংসা করে ভিয়েতনামের সরকার এবং জনগণ।
বাংলাদেশ বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য পরিবেশ বিনির্মাণে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বলেন, ভিয়েতনামের সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি অবলোকন করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ফলে রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শিগগিরই শুরু হবে বলে আশা করছি।’
বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের সম্পর্ক
বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭৩ সালে। স্বাধীনতার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের যুদ্ধকে সমর্থন এবং ভিয়েতনামে চালানো বোমা হামলার নিন্দা জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
ঢাকার ভিয়েতনাম দূতাবাসের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ এবং এশিয়ার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক শাসনের বাইরে থাকা দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভিতেনামকে স্বীকৃতি দেয়া এবং তাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালের পর থেকে অনেক উন্নতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ ১৯৯৩ সালের ১১ মে হ্যানয়ে দূতাবাস স্থাপন করে এবং ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় পুনরায় দূতাবাস চালু করে ভিয়েতনাম।
রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বাংলাদেশের সাফল্যের বিষয়ে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম কথা তুলে ধরেন।
তিনি বাংলাদেশ ও তার জনগণকে ভিয়েতনামের ‘দক্ষিণ এশিয়ার খুব ভালো বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়া আমার জন্য বড় সম্মানের বিষয়।’
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করে রাষ্ট্রদূত ভিয়েত চিয়েন বলেন, উভয় দেশ একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি অদূর ভবিষ্যতে বিশেষত অর্থনীতির ক্ষেত্রে দুদেশের সম্পর্ক আরও ভালো হবে।’