একের পর এক বিস্ফোরণ এবং সড়কে লড়াইয়ের জেরে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
শহরটির মেয়র ভিটালি ক্লিচস্কো বলেছেন,‘কারফিউ চলাকালীন রাস্তায় থাকা বেসামরিক নাগরিকদের শত্রু পক্ষের লোক বা সাহায্যকারী দলের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’
রুশ সেনারা রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে ভূগর্ভে আশ্রয় নিচ্ছেন। রাশিয়ান সেনারা কতদূর অগ্রসর হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট জানা যায়নি। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা রুশ হামলা প্রতিরোধে কিছু সাফল্যের কথা জানিয়েছেন, তবে রাজধানীর প্রান্তে লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
দেশটির প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি নিরাপদে দেশ ছাড়ার মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন,শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন।
অন্যদিকে রাশিয়ার দাবি, তারা শুধু ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা করছে, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে এই হামলায় সবচেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে।
আরও পড়ুন: রুশ হামলায় ১৯৮ জন নিহত, আহত সহস্রাধিক: ইউক্রেনের মন্ত্রী
একটি ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভের একটি বিমানবন্দরের কাছে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকণ্ঠে উঁচু অ্যাপার্টমেন্টে আঘাত হেনেছে। অ্যাপার্টমেন্টটির বেশ কয়েকটি তলায বিধ্বস্ত হয়েছে।
একজন উদ্ধারকর্মী জানিয়েছেন, এই হামলায় ছয়জন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।
ইতোমধ্যে কয়েক হাজার ইউক্রেনীয় বাড়িঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন, এক লাখ ২০ হাজারের বেশি ইউক্রেনীয় পোল্যান্ড, মলদোভা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
রুশ সেনারা উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দুই দিনের ব্যাপক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর শনিবারের প্রকাশ্য সড়কে সংঘর্ষ হয়। হামলার ফলে সেতু, স্কুল এবং আবাসিক এলাকা ভেঙে পড়ছে এবং শত শত মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটছে।
এখনও এটা স্পষ্ট না যে ইউক্রেনের কতটা এখনও ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং কতটা রুশ বাহিনী দখল করেছে।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, রুশ সামরিক বাহিনী আজভ সাগর উপকূল থেকে প্রায় ২২ মাইল অভ্যন্তরীণ দক্ষিণের শহর মেলিটোপোলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
আরও পড়ুন: কিয়েভের সড়কে লড়াই শুরু
তারা আরও বলেছে, রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডনবাসের পূর্ব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে সফল হয়েছে।
ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। ইউক্রেনের অবকাঠামো মন্ত্রণালয় বলেছে, একটি রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র শনিবার ভোরের আগে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের সরকারকে উৎখাত করতে এবং তার নিজের ইচ্ছাধীন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করতে বদ্ধপরিকর। এই আক্রমণের মাধ্যমে পুতিন ইউরোপের মানচিত্র পুনরায় আঁকতে এবং মস্কোর স্নায়ু-যুদ্ধ যুগের প্রভাবকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। এর ফলে পুতিনের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দেয়াসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনার সূত্রপাত করছে।
জেলেনস্কি শনিবার নতুন করে আশ্বাস দিয়ে বলেছে,দেশের সামরিক বাহিনী রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে।
কিয়েভ থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিওতে তিনি বলেন, তিনি শহরেই রয়েছেন এবং ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে এটা মিথ্যা দাবি।
তিনি বলেন, আমরা অস্ত্র প্রত্যাহার করব না। আমরা দেশকে রক্ষা করব। আমাদের অস্ত্রই এখন আমাদের বড় সত্য এবং আমাদের ভূমি, আমাদের দেশ ও আমাদের সন্তান সবই সত্য। আমরা আমাদের সবকিছুকে রক্ষা করব।
জেলেনস্কি শনিবারে রেকর্ড করা দ্বিতীয় ভিডিওতে বলেন, মস্কোর দ্রুত রাজধানী দখল এবং একটি পুতুল সরকার স্থাপনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। আবেগঘন বক্তব্যে তিনি রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বেসামরিক এলাকা ও অবকাঠামোতে আঘাতের অভিযোগ তোলেন।
আরও পড়ুন: পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের
বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে একটি ফেনালাপে জেলেনস্কি বলেন, তিনি রাশিয়ার এক নম্বর টার্গেট এবং তারা তাকে আর জীবিত দেখতে নাও পারেন।
এরই মধ্য ইউক্রেন থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তবে জেলেনস্কি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
একজন সিনিয়র মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, মার্কিন প্রস্তাবের জবাবে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘এখানে লড়াই হচ্ছে, আমার গোলাবারুদ এবং অস্ত্র দরকার, আমাকে সরিয়ে নেয়ার দরকার নেই। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাব।’
শনিবার ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া রুশ আক্রমণে এখন পর্যন্ত তিন শিশুসহ ১৯৮ জন নিহত এবং সহস্রাধিক মানুষ আহত হয়েছে। তবে হতাহতরা সামরিক নাকি বেসামরিক নাগরিক বিবৃতি থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়নি।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধে শত শত রুশ সেনা নিহত হয়েছে। তবে রুশ কর্তৃপক্ষ কোন হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি।
জাতিসংঘ অনুমান, যুদ্ধ আরও বাড়লে চার মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যূত হতে পারে। হাঙ্গেরির সীমান্ত শহর জাহোনিতে আগত শরণার্থীরা বলেছেন যে যুদ্ধ করার মতো উপযুক্ত বয়সী পুরুষদের ইউক্রেন ছেড়ে যেতে দেয়া হচ্ছে না।