করোনাভাইরাস আতঙ্কে অনেকটাই শূন্য হয়ে গেছে গোয়ার প্রাণবন্ত সমুদ্র সৈকত এবং স্তিমিত হয়ে পড়েছে সেখানকার প্রতিদিনকার পরিচিত হৈ-হুল্লোড়।
১৯৬১ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজ উপনিবেশ থাকা পর্যটন নির্ভর ভারতের পশ্চিমের এ রাজ্যটি সাধারণত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে অনেক বেশি প্রাণবন্ত থাকে।
নিয়মিত পর্যটক ও ধনী অবকাশ যাপনকারীদের জন্য মৌসুমি পর্যটন কেন্দ্র থেকে গত এক দশকে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ‘সেকেন্ড হোম’ হয়ে উঠেছে গোয়া।
তবে করোনা মহামারি এবং এ কারণে জারি করা ভ্রমণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ সবকিছুতেই পরিবর্তন এনেছে, সম্ভবত চিরকালের জন্য।
ভারতে অনুমোদন পেল করোনার দুই ভ্যাকসিন
ক্যান্ডোলিম থেকে কালাঙ্গুট হয়ে মরজিম পর্যন্ত উত্তর গোয়ার জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকতগুলোতে থাকা বেশ কিছু জনপ্রিয় কফি শপ, ট্যাটু পার্লার এবং বার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রাণ হারিয়েছে জনপ্রিয় পার্টি কেন্দ্রগুলোর রাতের পরিবেশ।
আরব সাগরের দক্ষিণে গোয়ার প্রায় নির্জন ইউটোর্দা সমুদ্র সৈকতের বিপরীতে নীল শাড়িতে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন পাথর দিয়ে তৈরি গহনা বিক্রেতা সীমা রাজগড় (৩৭)। তবে মুষ্টিমেয় দেশীয় পর্যটকদের কেউই তা কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখালেন না।
তিন সন্তানের জননী সীমা জানান, ছুটির মৌসুমের ভালো দিনগুলোতে তিনি প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার রুপি (২৭ ডলার) উপার্জন করতেন।
কিন্তু বর্তমানে খারাপ সময় চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন আমি অনেক কষ্টে কমবেশি মাত্র ২০০ রুপি (প্রায় ৩ ডলার) উপার্জন করি, যা আমার সন্তানদের জন্য দুধ এবং খাবার কেনার জন্যও যথেষ্ট নয়।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত মার্চ মাসে আরোপিত দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালে চাকরি হারান সীমার স্বামী। এখনও বেকার রয়েছেন তিনি।
করোনা: নেগেটিভ সনদ না থাকায় ভারতফেরত ৩৩ জন কোয়ারেন্টাইনে
সন্তানদের বেশ কয়েক মাসের স্কুল ফি এবং তিন মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া রয়েছে জানিয়ে সীমা বলেন, ‘এ ভাইরাস আমাদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।’
রাজ্য পর্যটন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি বিদেশী পর্যটকসহ গোয়া সফর করেছেন ৮০ লাখের বেশি পর্যটক। এখানে রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য ও জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে কমপক্ষে ৮০০ চার্টার্ড বিমান।
গত আগস্ট পর্যন্ত ২ লাখ ৮০ হাজারের কিছু বেশি বিদেশি পর্যটকসহ গোয়া সফর করেছেন কেবলমাত্র ১১ লাখ পর্যটক।
গোয়ায় কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এক সরকারি প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়, এপ্রিল-মে মাসে লকডাউনের কারণে পর্যটন শিল্পে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের লোকসান হয়েছে। এছাড়া ৩৫ থেকে ৫৮ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ১৫ লাখ জনসংখ্যার গোয়া রাজ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন পর্যটন সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে জড়িত।
কোভিড-১৯: ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ছাড়াল
ভারতের এ রাজ্যটিতে এখন পর্যন্ত ৫১ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ৭৪৯ জনের।
গত গ্রীষ্মে লকডাউনের সময় ঘরে বসে থাকা ডিজাইনার সুমান ভাট যার বিলাসবহুল ব্র্যান্ড ‘লোলা বাই সুমানবি’ বলিউড সেলিব্রিটিদের কাছেও জনপ্রিয়, তিনি দ্বিধায় রয়েছেন যে গোয়ার রাজধানী পাঞ্জিমে তার ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ডের দোকানটি বন্ধ করে দেবেন নাকি পণ্য বিক্রির অপেক্ষায় থাকবেন।
ভাট তার কর্মীদের ধরে রাখতে পেরেছেন, তবে তাকে ছাড়তে হয়েছে দোকানের জন্য নিজের পছন্দের স্থান। গত আগস্টে ‘লোলা বাই সুমানবি’ স্থানান্তর করেছেন তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল একটি স্থানে।
তিনি বলেন, ‘এটা আমার জন্য এক কঠিন বিদায় ছিল। গ্রাহককে ভালো অভিজ্ঞতা দিতে আপনি ব্যবসায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন কিন্তু এখন সেটি আপনার কাছ থেকে পুরোপুরি কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারও পক্ষে আপনার পণ্যটি দেখা, স্পর্শ করা এবং অনুভব করার কোনো উপায় নেই।’
ভাট আরও বলেন, স্যানিটাইজেশন, পরীক্ষা ও উদ্বেগে থাকার নতুন এ রুটিনে তার কর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মহামারি কবে শেষ হবে সেটি এখনও অজানা থাকায় ভবিষ্যত অনিশ্চিতও রয়ে গেছে।
‘আমার তৈরি পোশাকগুলো কি সান্ধ্য পোশাক হতে পারবে যদি উপভোগ করার মতো সন্ধ্যাই না থাকে? চলমান পরিস্থিতিতে সবাই যখন সঞ্চয় করার চেষ্টা করছে, তখন মানুষকে কি এত টাকা ব্যয় করতে বলা উচিত?’ নিজেকেই প্রশ্ন করেন সুমান।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আপনি জানেন না কখন আপনার কোন কর্মী বলবে যে তার জ্বর হয়েছে। আপনি তখন কী করবেন? সব বন্ধ করে দেবেন? সবাইকে পরীক্ষা, স্যানিটাইজ এবং স্প্রে করতে বলবেন? আপনার ভেতর সবসময় সমস্যা সমাধানের মনোভাব থাকবে না।’
লকডাউন তুলে নেয়ার কয়েক মাস পর গোয়া কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। বছর শেষের ছুটিতে বেড়েছে দেশীয় পর্যটকদের আগমন। ক্যাসিনোগুলো আবার খোলা হয়েছে এবং পর্যটকদের এখন আর করোনাভাইরাস নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদর্শন করার প্রয়োজন হচ্ছে না।
করোনার ভ্যাকসিন কিনতে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে সরকারের চুক্তি
তবে সবকিছু এখনও ফিরে আসেনি স্বাভাবিক অবস্থায়।
কী কী হারিয়েছেন তা বুঝে উঠতে সংগ্রাম করছেন যোগব্যায়াম শিক্ষক শরণ্য নারায়ণান।
৩৪ বছর বয়সী নারায়ণান ২০০৮ সালে মুম্বাই থেকে গোয়ায় আসেন একটি ক্লাবে এরিয়াল অ্যাক্রোব্যাটিক্স করতে এবং এখানেই থেকে যান।
তিনি একাধিক স্থানে শিক্ষকতা করছিলেন তবে লকডাউনের সময় এ জন্য তাকে স্থানান্তর হতে হয় ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে।
আগস্টে যখন যোগব্যায়াম কেন্দ্রগুলোকে পুনরায় চালু করার অনুমতি দেয়া হয়, তখন তার কেবল একটি চাকরিই ফিরে এসেছিল- তার নিজস্ব ক্লাস।
‘মহামারিটি আমার জীবনসহ সবার জীবনই বদলে দিয়েছে,’ বলেন নারায়ণান।