কোভিড-১৯ এর অসম প্রভাব উঠে এসেছে গেটস ফাউন্ডেশনের বার্ষিক গোলকিপারস প্রতিবেদনে। নতুন তথ্য বলছে,বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে প্রবল অঘটন এড়ানো সম্ভব হয়েছে। এখন বৈশ্বিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ এবং সার্বিকভাবে অতিমারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মঙ্গলবার বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন (বিএমজিএফ)এর পঞ্চম বার্ষিক গোলকিপারস প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণের ক্ষেত্রে কোভিড অতিমারি কীভাবে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা তথ্যসহকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগের আহবান কৃষিমন্ত্রীর
গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার বিল গেট্স ও মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেট্স যৌথভাবে এবারের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। কোভিড-১৯ সমাজে যেসব অসম প্রভাব ফেলেছে তা ধরা পড়েছে এই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই অতিমারিতে যারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগবে। করোনার কারণে ২০১৯-এর তুলনায় ২০২১ সালে আরও তিন কোটি ১০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন। আর্থিক দিক থেকে উন্নত ৯০ শতাংশ দেশের নাগরিকের মাথাপিছু আয় আগামী বছরের মধ্যে অতিমারির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু আর্থিক ভাবে দুর্বল নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মাত্র এক তৃতীয়াংশই আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে। তবে আশার কথা হল, বিশ্বের মানুষ এই ধ্বংসলীলা মোকাবিলা করেছে, তাই আরও খারাপ কিছু হওয়া আটকানো গেছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় জাপান
গত বছরের গোলকিপারস প্রতিবেদনে 'ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন' (আইএইচএমই ) অনুমান করেছিল, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন (টিকা) প্রদান ১৪ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে মাত্র ২৫ সপ্তাহে ২৫ বছরের অগ্রগতি হারিয়ে যাবে। তবে আইএইচএমই এর নতুন বিশ্লেষণ অনুযায়ী লেখচিত্র নিম্নমুখী হলেও পরিস্থিতি যতটা খারাপ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, বাস্তবে ঘটেছে তার অর্ধেক।
এ বছরের প্রতিবেদনে ‘যুগান্তকারী উদ্ভাবন’ এর উপর অধিক আলোকপাত করেছেন প্রতিবেদন প্রনয়ণকারী বিল গেট্স ও মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস। গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা,প্রতিশ্রুতিপূরণ এবং বিনিয়োগের ফলেই এ ‘যুগান্তকারী উদ্ভাবন’ সম্ভব হয়েছে। তবে খুব খারাপ কিছু হওয়া যে আটকানো গেছে, তা প্রশংসনীয় হলেও যথেষ্ট নয় বলে তারা প্রতিবদেনে উল্লেখ করেছেন।
প্রতিবেদনে,যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল ঠিক সেভাবেই অতিমারির ধাক্কা সার্বিকভাবে কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্য এবং আর্থিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এর মধ্য দিয়েই জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণের পথে বিশ্বকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়াররা।
প্রতিবেদনে তারা লিখেছেন, ‘(গত বছরে) আমাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে যে, অগ্রগতি অপরিহার্য এবং সম্ভব।বিগত ১৮ মাসে যে বিষয়গুলোতে আমরা ভাল করেছি, সেগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমরা অতিমারির ধাক্কা কাটিয়ে স্বাস্থ্য, খাদ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর অগ্রগতি তরান্বিত করতে পারব।’
আরও পড়ুন: ফিনল্যান্ডকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
এ প্রতিবেদনে আরও একটি বিষয় গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে। অতিমারির প্রভাবে সারা বিশ্বে আর্থিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নারীরা। উচ্চ আয়ের দেশ হোক বা নিম্ন আয়ের দেশ, অতিমারির ফলে যে আর্থিক মন্দা তৈরি হয়েছে তাতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা অনেক বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মেলিন্ডা গেটস বলেন, ‘এমনিতেই বিশ্বের নানা স্থানে নারীরা নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হন। অতিমারি সেই বাধা-বিপত্তিগুলোকে আরও জোরালো করেছে।’ তার মতে, ‘বিভিন্ন দেশের সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের উন্নয়নে জোর দেয়া, যাতে তাদের সামনের বাধা এবং বৈষম্য দূর করা যায়। এতে যে শুধু সার্বিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে তাই নয়, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে। এটা করা যে শুধু ঠিক তাই নয়, বরং এমনটা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ এবং এতে সবাই লাভবান হবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে দ্রুত গতিতে কোভিড-১৯ এর টিকা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে তা কোনো ‘আশ্চর্য’ ব্যাপার নয় বরং গত কয়েক দশক ধরে চলমান বিনিয়োগ, ভ্যাকসিন নীতি এবং সহযোগিতার মাধ্যমে যে পরিকাঠামো, পরিবেশ এবং প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছে, এ হল তারই ফল। তবে যে পরিকাঠামোয় ভর করে অভূতপূর্ব গতিতে কোভিড-১৯ এর টিকা তৈরি করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া গেছে তা মূলত রয়েছে বিত্তশালী দেশগুলোতে। ফলে সারা বিশ্বের মানুষ সমানভাবে লাভবান হয়নি।
বিল গেটস লিখেছেন, ‘কোভিড-১৯ টিকার অসমন বণ্টন জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিপর্যয় ডেকে আনবে। ফলে আগামী দিনে বিত্তশালী দেশগুলোর কাছে কোভিড-১৯ দরিদ্রের রোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ, আয় নির্বিশেষে সকলের কাছে এ টিকা না পৌঁছানো পর্যন্ত এই অতিমারিকে অগ্রাহ্য করা ঠিক হবে না।’
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে ৮০ শতাংশের বেশি কোভিড টিকা উচ্চ এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোর নাগরিকদের কাছে পৌঁছেছে। কোথাও কোথাও প্রয়োজনের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ টিকা পৌঁছেছে যাতে বুস্টার ডোজও দেয়া যায়। অথচ নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মাত্র ১ শতাংশ টিকা পৌঁছনো গেছে। কারা কোভিড-১৯ টিকা পাবে আর কারা পাবে না, তার অনেকটাই নির্ভর করেছে কোথায় টিকা নিয়ে গবেষণা এবং উৎপাদন হচ্ছে তার উপর। বিশ্বের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশের বাস আফ্রিকা মহাদেশে, কিন্তু বিশ্বের টিকা উৎপাদন কেন্দ্রের মাত্র ১ শতাংশ সেখানে রয়েছে।
সব শেষে এ প্রতিবেদেন বিশ্বের কাছে সেই সব জায়গায় গবেষণা ও উন্নয়ন, পরিকাঠামো এবং উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে যেখানে মানুষের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
গেটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্ক সুজম্যান বলেন, ‘নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় টিকা এবং ওষুধ তৈরির জন্য সেখানে গবেষক এবং উৎপাদনকারী সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করলেই তা করা সম্ভব হবে। সারা বিশ্বের উদ্ভাবন এবং প্রতিভাকে একযোগে কাজে লাগানো গেলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোও মোকাবিলা করা যাবে।’