আমি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একটি শাখায় ‘গবেষণা পদ্ধতি’র ওপর ক্লাস নিই। এতে বিভিন্ন দেশের স্টুডেন্ট আছে। তার মধ্যে আছে আফগানীরা। এক মাস ধরে মার্কিনিদের চলে যাওয়া নিয়ে চারদিকে অনিশ্চিয়তা বিরাজ করছিল। আমার স্টুডেন্টরা মিড্ টার্ম পরীক্ষা দিয়েছে সবাই, রেজাল্ট ভালো। কিন্তু আমার মনে ছিল বড় রকম দুশ্চিন্তা। ওদের কি হবে ? যুদ্ধ ঘরে আসলে ওরা কি করবে?
যা ঘটলো তালিবানদের হাতে
তালিবানরা দ্রুতভাবে এগুতে লাগলো দেখে সবাই অবাক। মার্কিনিরা নাকি ভেবেছিল ছয় মাস লাগবে ওদের কাবুল পৌঁছাতে। কিন্তু ওরা লাগালো মাত্র ১৫ দিন। মার্কিনিরা যে কত বাস্তব জ্ঞানহীন এটা তারই পরিচয়। যেখানেই যায় এটা ঘটে। ভিয়েতনাম ছেড়েছে এই ভাবে, আফগানিস্তানও ছাড়লো একই ভাবে নিজেদের মানুষদের পুরা বিপদের মধ্যে ফেলে।
একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই খেলা শেষ। প্রেসিডেন্ট গনি প্লেনে চড়ে পালিয়ে গেলো আর তালেবান কাবুল দখল করে ফেললো।
তোমাদের খবর কি ?
যে আমার ক্লাস সহায়ক এবং স্টুডেন্টদের সাথে যোগাযোগ রাখে তাকে বলেছি। সে আফগান স্টুডেন্টদের কয়েকটা মেসেজ পাঠানোর পর উত্তর আসলো। ‘আমরা ভালো আছি। কি হচ্ছে, কি হবে জানি না। চারদিকে অনিশ্চয়তা। তালিবানরা একের পর এক শহর দখল করছে। কাবুলের অনেক কাছে তারা। সবাইকে শুভেচ্ছা।’
এই কথায় নিশ্চিত হওয়ার মতো কিছু ছিল না। মেয়েটা আমাকেই আস্বস্ত করতে চাইছে মনে হলো। আমার ক্লাস সহায়ক একটা পোস্ট দিলো ফেসবুকে। লিখেছে, ‘কত দূরের যুদ্ধ, কত সহজে কাছে এসে যায়। আমার সহপাঠীদের জন্য খুব উদ্বিগ্ন। এখন সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়া দেখি, কোনো খবর আছে কিনা।’
যেদিন তালিবানরা কাবুল দখল করলো সেদিন আর একজনের মেসেজে এলো। লিখছে , ‘কি হবে জানি না। অনেকে পালাতে শুরু করেছে। পাশের দেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে অনেকে। আমার পরিবার নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত। কারণ আমরা সংখ্যালঘু। আমাদের কি হবে কে জানে! চারদিকে কি ঘটছে জানি না, বুঝি না।’
যুদ্ধের না বলা খবরগুলো হারিয়ে যায়
সেই দোমড়ানো মনটা নিয়ে আছি। কারণ আমি জানিনা ওদের কি অবস্থা। ওরা কষ্ট করে এই দেশে পড়তে এসেছিল, তারপর করোনার কারণে ফেরত যেতে হয়। আর এখন জীবনটাই বন্ধ। আমার মতো মানুষের জন্য আরও বেশি কষ্টের কারণ ওরা আমার শিক্ষার্থী, শিক্ষকের কাছে আপন সন্তানের মতো। আমি বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই সারাক্ষণ। অথচ এতো অসহায় লাগে নিজেকে। কিছুই করতে পারবো না, পারছি না।
১৯৭১ সালের একটা ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর আল- বদর এসে স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করে তাদের ছেড়ে তিনি চলে যান। কেন নিচ্ছে কেউ বোঝেনি, এখনো জানে না। ১৬ তারিখে সবাই আনন্দ করে। তখন পরিবারের লোকজন জানে না তার কি হাল। ভেবেছে যুদ্ধে জিতেছে, নিশ্চয় ফিরে আসবে। লাশ আর কোনোদিন পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধের বিজয় আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা কেউ বলে না।
লেখক: এডিটর এট লার্জ, ইউএনবি