সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে চলেছে। এ সময় মানুষের পাশাপাশি প্রাণহানির শিকার হচ্ছে পশু-পাখিও। বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতির এক বিরাট যোগান আসে গৃহপালিত পশু-পাখি জাত দ্রব্যাদি থেকে। তাছাড়া ঘরে পশু-পাখি লালণ-পালন করে অনেকেই বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা স্বাবলম্বি হচ্ছে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই মহামূল্যবান সম্পদকে রক্ষা করার প্রতি সতর্ক হওয়ার কোন অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে অবলা প্রাণীগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া বাঞ্ছনীয়। চলুন, ঝড় এবং বন্যায় কিভাবে গৃহস্থালি পশু-পাখির ব্যবস্থা করবেন তা জেনে নেয়া যাক।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পশু-পাখির সুরক্ষায় করণীয়
ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার সময় করণীয়
এ সময় সর্বত ভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে ঝড় বৃষ্টিতে গবাদিপশু যেন ভিজে না যায়। বন্যা, ঝড় অথবা জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাসের সঙ্গে সঙ্গেই গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগিকে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে নিতে হবে। বন্যার সময় পশু-পাখিকে নৌকা বা মাচার উপরে নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিজস্বভাবে অপারগ হলে সরকারি প্রতিষ্ঠান, সড়ক বা আশ্রয় কেন্দ্রগুলো উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। কোন ভাবেই পশু-পাখিকে ভেজা জায়গায় রাখা যাবে না।
অতিবৃষ্টির মৌসুমের আগ থেকেই কিছু খড় ও দানাদার খাদ্য সংরক্ষণ করতে হবে। এ সময় সাইলেজ তৈরি করা অথবা ইউরিয়ার মাধ্যমে খড় প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ অনেক কাজে লাগতে পারে। সবসময় চেষ্টা করতে হবে আর্দ্রতামুক্ত পরিবেশে খাদ্য সংরক্ষণ করা। যতটা সম্ভব ঘরের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। লিটার কোন ভাবেই ভিজতে দেয়া যাবে না।
এমন আপদকালীন সময়ের জন্য আগে থেকে খাদ্য মজুদ করে রাখতে হবে। এর জন্য উঁচু স্থানে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য উঁচু করে গুদাম ঘর নির্মাণ করা যেতে পারে। বিকল্প খাদ্য হিসাবে কলা, তুঁত, কাঁঠাল, ডুমুর, ইপিল-ইপিল, ডেউয়া, পাকুড়, আম, বাঁশ, জিগা, ও বট গাছের পাতা বন্যার ও শুষ্ক উভয় মৌসুমেই উপযুক্ত।
পড়ুন: কুড়িগ্রামে বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েছে, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট
ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য আগে থেকেই ঘরে শক্ত খুঁটি দিয়ে রাখতে হবে। নিয়মিত জীবাণু মুক্ত রাখার জন্য আগে থেকেই শেডের মেঝেতে চুন দেয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ছাই, কাঠের গুঁড়া বা বালু, তুষ ছড়িয়ে দেয়া এবং নিয়মিতভাবে তা বদলে দেয়া যেতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির পানি যাতে ঘরের ভেতরে না যায় সেজন্য ঘরের চারদিকে চটের বস্তা বা রেকসিনের পর্দা দিয়ে ঘেরাও করে দিতে হবে।
পশু-পাখি কোন ভাবেই যেন বন্যার দূষিত পানি কিংবা পচা খাবার না খায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বন্যার পানির নিচে ডুবে যাওয়া ঘাস; এমনকি বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন করে গজানো ঘাস পশুকে খাওয়ানো ঠিক নয়। নিজেদের আহারের উদ্বৃত্ত অংশ নষ্ট না করে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির জন্য রাখা যেতে পারে।
ঝড়-বৃষ্টির শুরুর আগেই হাস-মুরগি ও এগুলোর ডিম বাজারজাত করা জরুরি। প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এগুলো বাজারজাত করে ফেলা ভালো।
বন্যাতে পশুর ডায়রিয়া, তড়কা, বাদলা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, ক্ষুরারোগ প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। হাস-মুরগির ক্ষেত্রে রানীক্ষেত, কলেরা, ডাকপ্লেগ, বসন্ত, ছত্রাক ও অন্যান্য পরজীবীজনিত রোগের সংক্রমণের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। আগে ভাগেই প্রতিটি রোগের জন্য প্রতিষেধক টিকা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে মৃত পশু-পাখি পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। সর্বপরি, পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ও বন্যা পরবর্তী সময়ে যে কোনো সমস্যায় নিকটস্থ পশুসম্পদ দপ্তরের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।
পড়ুন: পদ্মায় পানি বৃদ্ধি, ভাঙন ঝুঁকিতে ৩৫০ পরিবার
খরার সময় করণীয়
এ সময় অতিরিক্ত গরম থাকে বিধায় গবাদিপশুকে যে কোন শেড বা গাছের নিচে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা উচিত। তাপমাত্রা কমানোর জন্য শেডের চালের ওপর পানি ছিটিয়ে দেয়া যেতে পারে। হাঁস-মুরগির ঘরের চালার ওপর চট বিছিয়ে তার ওপরেও একই ভাবে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
পানি যে কোন পাত্রে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলেই তা গরম হয়ে যায়, তাই পানি বেশিক্ষণ একই পাত্রে রাখা যাবে না। এ ক্ষেত্রে অল্প অল্প করে পাত্রে রেখে মাঝে মাঝে তা বদলে দেয়া যেতে পারে। এজন্য পানির পাত্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্যাংক থেকে সরাসরি পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে ট্যাংকটিকে কোনো কিছু দিয়ে আবৃত করে রাখতে হবে, যেন ট্যাংকের পানি গরম হয়ে না যায়।
পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে পশু-পাখির ঘরে। কমপক্ষে রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত আলোর ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। সিলিং ফ্যানের পাশাপাশি এক্সজস্ট ফ্যান স্থাপন করা একটা ভালো উপায়। আর গরম খুব বেশি বাড়লে ঘরে ফ্যানের সংখ্যা দুয়েকটা বাড়িয়ে পশু-পাখির সংখ্যা কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে রুমের তাপমাত্রা বোঝার জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার জরুরি। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেলে মুরগির ওপর ও ঘরের মেঝেতে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
গরমকালে পশুর খাদ্য গ্রহণের হার কম, তাই খাদ্যে যত বেশি সম্ভব প্রোটিন রাখতে হবে। গরম বাড়ার সাথে সাথে ভোর, সন্ধ্যা ও রাতে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়। এ সময় দুপুরের খাবারটা বন্ধ রাখা আবশ্যক। যথেষ্ট পরিমাণে বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা পানির যোগান দিতে হবে। রাত ঠিক ২টার পর থেকে খাবার ও পানি খাওয়ানো যেতে পারে। পাত্রের খাবার পানি গরম হচ্ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রেখে পুনরায় বদলে দিতে হবে। ঠাণ্ডা পানির সাথে ইলেকট্রোলাইট্স এবং ভিটামিন-সি দেয়া উত্তম।
প্রচন্ড গরমে গবাদি পশু হিটস্ট্রোক, ম্যাসটাইটিস, ধকল, অ্যানাপ্লাজমোসিস, থাইলেরিওসিস, বেবিসিসিস, গলাফুলা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া মশা-মাছির প্রকোপ তো আছেই। এ ব্যাপারে পশুর সম্ভাব্য উপসর্গগুলোর প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। রাতে বা খুব ভোরে হাস-মুরগীর জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দেয়া হয়। অত্যাধিক গরমের এই পথ্যটি অন্যান্য সময়ে প্রদানের দুই থেকে তিন দিন পর দেয়া যেতে পারে।
পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ (হাই প্রেশার) হলে যা এড়িয়ে চলা উচিত: ক্ষতিকর খাবার, পানীয়, অভ্যাস
শৈত্য প্রবাহের সময় করণীয়
শেডে বেড়া এবং চারদিকে চট বা প্লাস্টিকের পর্দা ঝুলিয়ে দিলে অতিরিক্ত ঠান্ডার সময় বেশ কাজে দেয়। টিনের শেডে সিলিং থাকা জরুরি আর শেডের ওপর চট বা খড় বিছিয়ে দিলে ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর জন্য গবাদিপশুর গায়েও চট দিয়ে ঢেকে দেয়া যায়। শেডের ভেতরে বা ব্রুডারে ১০০ থেকে ২০০ ওয়াটের বাল্ব, আগুন জ্বালিয়ে রাখা বা বৈদ্যুতিক হিটার সংযোজন ঘরে প্রয়োজনীয় তাপ সরবরাহ করবে।
লোডশেডিং-এর সময় ঘরের ভেতর হ্যাজাক বা হারিকেন দিতে হবে। শেডের মেঝেতে লিটার দেয়ার সময় তার পুরুত্ব চার ইঞ্চি রাখতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি স্যাঁতসেঁতে হয়ে না যায়। শেডের চালের নিচ দিয়ে যথেষ্ট আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা দরকার।
পশু-পাখি যেন সুষম খাদ্য পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খাবারে প্রোটিনের মাত্রা বেশি থাকতে হবে এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত হতে হবে। কুসুম গরম পানির সাথে খাবার সরবরাহ করতে হবে। পানিতে ভিটামিন-সি, এ, ডি ও ই মিশিয়ে দেয়া উত্তম। এ সময় বিশেষ করে গর্ভবতী গাভী ও বাছুরের প্রতি আলাদা ভাবে বেশি যত্ন নেয়া দরকার।
ঠান্ডায় গবাদিপশুর রোগগুলোর মধ্যে আছে সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়া। হাস-মুরগির সর্দি-কাশি, সিআরডি, ব্রুডার নিউমোনিয়া ও আমাশয়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ বিষয়গুলোতে আগে থেকেই নিকটস্থ পশুসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করে পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পড়ুন: স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিংক সল্ট বা হিমালয় লবণের উপকারিতা
শেষাংশ
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পশু-পাখির সুরক্ষার্থে উপরোক্ত পদ্ধতিগুলো বেশ কার্যকরি ভূমিকা পালন করবে। নিদেনপক্ষে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও দুর্যোগের পরে ক্ষতিপূরণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা যাবে। দুর্যোগ পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আবার নতুন করে শুরু করতে বেশ বেগ পেতে হয়। সে সময় গৃহপালিত পশু-পাখিগুলোই শেষ অবলম্বন হিসেবে দেখা দেয়। তাই নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই এই বহু কষ্টে লালিত সম্পদগুলোর যথাযথ যত্ন নেয়া উচিত।