বাংলা সাল্তানাত, বার ভূইয়া ও মুঘল সাম্রাজ্যের কিংবদন্তি নিয়ে রাজকীয় ভাবে নিজের অবিস্থিতির জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নগরী সিলেট। সুরমা নদীর উত্তর তীর ঘেষে পাহাড়ী মাটিতে পরিণত এই উচ্চভূমির ভূখন্ডটিকে এক অপার সৌন্দর্য্য দান করেছেন এর বিলগুলো। উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ুর যত্নে ছেয়ে যাওয়া চা-বাগানগুলো সিলেট শহরের মুল আকর্ষণ। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় ঢাকা থেকে স্থলপথে ২৪০ কিলোমিটার দূরত্বের এই শহরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দেশের অর্থনীতিতে। আজকের নিবন্ধটিতে প্রকৃতি ও ইতিহাসের অমৃত সুধায় ভরা সিলেট শহরের কিছু সেরা দর্শনীয় স্থানকে তুলে ধরা হবে।

সিলেট শহরের দশটি দর্শনীয় স্থান

জাফলং

এক সময়ের খাসিয়া জৈন্তা রাজার বিশাল সাম্রাজ্য কালের বিবর্তনে পরিণত হয়েছে ছোট্ট জাফলং-এ। ১৯৫৪ সালে শেষবারের মত জমিদারী প্রথা বিদায় হলেও পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ বুক সযত্নে ধরে রেখেছিলো এর সম্পদতূল্য পাথরগুলো। আর এই পাথরের জন্যই অবারিত বনভূমি হারিয়ে যাওয়ার পরেও এখানে গড়ে উঠেছিলো নতুন জনবসতি।

সেই জনবসতিই এখন পর্যন্ত সমুজ্জ্বল রেখেছে সিলেট থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে তামাবিল সীমান্তের পার্শ্ববর্তী এই জায়গাটিকে। মেঘালয়ের মেঘের পর্দা ভেদ করে ধূসর পাহাড়ের পদরেখা আর নদীর তীর ধরে অনন্তের মাঝে বাধা হয়ে দাড়ায় ঝুলন্ত ব্রিজ। লোকাল বাস, অটো রিকশা বা মাইক্রোবাস নিয়ে আড়াই ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যেতে পারে এই অপার সৌন্দর্য্যের লীলাভূমিতে।

পড়ুন: গরমকালে কম খরচে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবেন?

রাতারগুল

সিলেট মহানগর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রাতা নামক গাছে আচ্ছাদিত এই জলাভূমিটি।  রাতারগুলের মধ্যে দিয়ে গোয়াইন নদী যেয়ে মিশেছে চেঙ্গীর খাল-এ। শুধু এই রাতারগুল-ই নয়, গোটা সিলেটটাই ভ্রমণের জন্য সেরা সময় হলো বর্ষাকাল। বুনো প্রকৃতিকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যাবে। বনের গহীনে পাওয়া যাবে বন্য কাঠ গোলাপ।

সিলেট এয়ারপোর্টের বাইপাস হয়ে মাত্র দেড় ঘন্টা দূরত্বের এই জায়গাটিতে দিনে যেয়ে দিনেই ফিরে আসা যায় শহরে। জলাভূমির বনটি ঘুরে দেখতে গাড়ি থেকে মোটরঘাটে নেমে নৌকা ভাড়া করতে হবে।

তামাবিল

বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে হলে ঘুরে আসতে হবে গোয়াইনঘাট উপজেলার এই জায়গাটিতে। এটি বাংলাদেশ-ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মধ্যে সিলেট থেকে শিলং-এর মাঝের সীমান্ত সড়কের চৌকি। জাফলং থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার হওয়ায় সিলেটে ফেরার পথে তামাবিল ঘুরে যাওয়া যেতে পারে। এখানে পাহাড় ও ঝর্ণার নয়নাভিরাম দৃশ্যের সাথে উপভোগ করা যাবে সবচেয়ে কাছের নদী তাইরঙ্গল।

সিলেট শহর থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিয়ে শিবগঞ্জ হয়ে তামাবিলে পৌছতে হয়। এছাড়া সিলেট সদরের যেকোন স্থান থেকে জাফলং-এর বাস বা অটোরিকশা করেও তামাবিল পৌছা যাবে।

পড়ুন: সীতাকুণ্ড ডে ট্যুর: একদিনে ঘুরে আসুন চন্দ্রনাথ পাহাড় ও মহামায়া লেক

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর

ভোলাগঞ্জের এই পথ দিয়ে এক সময় স্থানীয়দের ভারতের আসামের রাজধানী শিলং-এ যাওয়া আসা হতো। ধীরে ধীরে এই পথটি পরিণত হলো রজ্জুপথ-এ, যার নাম দেয়া হলো ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে। এখন নদীর তীরে সাদা বালি, পানির নিচে সাদা পাথর দেখে নিমেষেই নামকরণের সার্থকতা অনুধাবন করা যায়।

সিলেট শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের এই দর্শনীয় স্থানটিতে যেতে সময় লাগবে প্রায় ১ ঘন্টা। ভোলাগঞ্জে নেমে সেখান থেকে নৌকা নিয়ে প্রায় ২০ মিনিটেই চলে যাওয়া যাবে সাদা পাথর নামক জায়গাটিতে। এখানে পর্যটকরা টিউব নিয়ে স্বচ্ছ পানিতে ভেসে অথবা প্যাডেল বোটে চড়ে মেঘালয়ের চূড়ায় মেঘের খেলা উপভোগ করে।

হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার

দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ সিলেট বিজয় করে এর শাসনভার অর্পনের প্রস্তাব দেন দরবেশ শাহ জালাল (র.)কে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। কিন্তু সুলতান দরবেশের সম্মানে সিলেট শহরকে খাজনা মুক্ত করেন। এই নিয়ম এখন শুধু শাহজালাল (র.)-এর মাজার বা দরগাহ শরীফের সংশ্লিষ্ট এলাকায় অব্যাহত আছে। বাংলার সুলতানগণ এই দরগাহ নির্মাণ করেন ১৪০০ সালে। এখানকার শেখ রাজপুরুষগণ মাথায় পাগড়ি পড়ে অনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতি দরবেশের সম্মতি নিতেন। অন্যথায় তাদেরকে শাসনকর্তা হিসেবে মানা হতো না।

পড়ুন: সিঙ্গাপুর ভ্রমণ: সাগরের উপকন্ঠে অভিজাত উদ্যাননগরী

সিলেট সদরেই আম্বরখানা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার গেলেই পৌছা যাবে শাহ জালালের মাজারে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক ও শাহ জালালের ভক্তরা এখানকার জালালী কবুতর, গজার মাছের পুকুর, স্বয়ং দরবেশ ও তাঁর অনুসারীদের ব্যবহৃত রান্নার সরঞ্জাম ও সোনালী মাছের কুয়া দেখতে আসেন।

বিছনাকান্দি

সিলেট থেকে সড়কপথে ৪০ কিলোমিটার পেরুলেই দেখা মিলবে গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দির। ভারতের খাসি পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা ঝর্ণার একটি ধারা গিয়ে মিশেছে পিয়াইন নদীতে, আর আরেকটি ধারা সৃষ্টি করেছে এই নিসর্গটি। পাথুরে নদীর মাঝে জেগে থাকা ছোট্ট দ্বীপগুলোর ঘরবাড়ি এক অপার্থিব অনুভূতি দেবে। আর দূরের পাহাড় যেন সযত্নে আগলে রেখেছে এই ছোট্ট স্বর্গটিকে।

সিলেট এয়ারপোর্ট সড়কের বাইপাস দিয়ে আড়াই ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যাবে হাদারপাড়। এখান থেকে নৌকায় করে প্রায় ১ ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যাবে বিছনাকান্দি। তবে জায়গাটির পুরো সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে বিছনাকান্দি সহ বড়হিল বা পান্থুমাই ঝর্ণা ও লক্ষনছড়াও ঘুরে আসতে হবে।

পড়ুন: ফ্লাই ডাইনিং: কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাংলাদেশের প্রথম ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট

লালাখাল

সিলেট শহর থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরে তামাবিল রোডের কাছেই অবস্থিত এই জায়গাটিকে বক্ষে ধারণ করে থাকা নদীটির নাম সারি নদী। এ নদী পথেই বাংলাদেশে এসেছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। নদীর চোখে প্রকৃতিকে দেখতে হলে ভ্রমণে আসতে হবে এখানে।

প্রায় আড়াই ঘন্টা খরচ করে শুধুমাত্র অটোরিকশা বা রিজার্ভ গাড়িতে করেই পৌছতে হবে সারি নদীর ঘাটে। তারপর নৌকা ঠিক করে ২ ঘন্টার জন্য হারিয়ে যাওয়া জলজ সৌন্দর্য্যে। সবুজ চা বাগান আর গোধূলির আলো মেশা বালিয়ারি সহসা ম্লান করে দিতে পারে পৃথিবীর যত চাঞ্চল্যকে।

মালনীছড়া চা বাগান

চা-এর দেশ হিসেবে শ্রীমঙ্গলের পরিচিতি থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে চা চাষের শুরু হয়েছে সিলেটের এই মালনীছড়া থেকেই। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বহু বৃটিশ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি ব্যবস্থাপকের হাত ঘুরেছে জায়গাটি। অবশেষে ১৯৮৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে রয়েছে সিলেট এয়ারপোর্ট থেকে স্বল্প দূরত্বে থাকা এই চা বাগানটি।

পড়ুন: কলকাতা ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার উপায় ও খরচ

বাগানে ঢোকার আগে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। সবুজ গালিচা ঘেরা বাংলোটিও ভ্রমণে দারুণ মাত্রা যোগ করতে পারে। সিলেট সদরের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে অটো রিকশাতে যেতে ১৫ মিনিট আর রিকশায় যেতে সর্বোচ্চ আধ ঘন্টা সময় লাগতে পারে।

হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজার

দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ সিলেট বিজয় করে এর শাসনভার অর্পনের প্রস্তাব দেন দরবেশ শাহ জালাল (র.)কে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। কিন্তু সুলতান দরবেশের সম্মানে সিলেট শহরকে খাজনা মুক্ত করেন। এই নিয়ম এখন শুধু শাহজালাল (র.)-এর মাজার বা দরগাহ শরীফের সংশ্লিষ্ট এলাকায় অব্যাহত আছে। বাংলার সুলতানগণ এই দরগাহ নির্মাণ করেন ১৪০০ সালে। এখানকার শেখ রাজপুরুষগণ মাথায় পাগড়ি পড়ে অনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রতি দরবেশের সম্মতি নিতেন। অন্যথায় তাদেরকে শাসনকর্তা হিসেবে মানা হতো না।

পড়ুন: সিঙ্গাপুর ভ্রমণ: সাগরের উপকন্ঠে অভিজাত উদ্যাননগরী

সিলেট সদরেই আম্বরখানা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার গেলেই পৌছা যাবে শাহ জালালের মাজারে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক ও শাহ জালালের ভক্তরা এখানকার জালালী কবুতর, গজার মাছের পুকুর, স্বয়ং দরবেশ ও তাঁর অনুসারীদের ব্যবহৃত রান্নার সরঞ্জাম ও সোনালী মাছের কুয়া দেখতে আসেন।

খাদিমনগর পার্ক

জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃত সিলেটের এই দর্শনীয় স্থানটি মূলত ৬ টি চা বাগানে ঘেরা। ২টি ট্রেইলের বিশাল বাগানটি ঘুরিয়ে দেখতে সাহায্য করবে একজন গাইড। সিলেট শহর থেকে যে পথটি জাফলং-এর দিকে চলে গেছে সেদিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার গেলে পড়বে শাহপরানের মাজার। হযরত শাহ পরাণ (র.) হযরত শাহ জালাল (র.)-এর ভাগ্নে ছিলেন।

মাজারে গেট আরেকটু সামনেই খাদিমনগর পার্ক। শহর থেকে অটোরিকশা যোগে দেড় ঘন্টাতেই চলে যাওয়া যাবে এই পার্কে। কাঁচা ইটের রাস্তায় সবুজে ছাওয়া পুরো উদ্যান জুড়ে সঙ্গ দিবে দুর্লভ প্রজাতির গাছগুলো।

পড়ুন: ১৫৫ দেশ ভ্রমণের রেকর্ড গড়লেন নাজমুন নাহার

আলী আমজাদের ঘড়ি

সিলেট মহানগরীতে প্রবেশের মুখে কীন ব্রিজের পাশে সুরমা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি। ১৮৭৪ সালে কুলাউড়াস্থ পৃত্থিমপাশার জমিদার আলী আহমদ খান ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন। ছেলে আলী আমজাদের নামে তিনি এই স্থাপনাটির নামকরণ করেন।

পড়ুন: হিমাচল, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ ভ্রমণ: দর্শনীয় স্থান ও খরচ

মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে এটি বিধ্বস্থ হয়ে গিয়েছিলো। স্বাধীনতার পর ১৯৮৭ সালে এটি মেরামত করে আবার চালু করা হয়। এরপরে আরো দুইবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মেরামত করা হয়। অবশেষে ২০১১ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশন ঘড়িটিকে মেরামত করার পর থেকে আজ অব্দি তা সচল আছে।

প্রতি ঘন্টায় ঘন্টা বাজিয়ে ঘড়িটি শহরবাসীকে সময় জানান দেয়। আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে রিকশা করে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই পৌছানো যায় আলী আমজাদের ঘড়িঘরে।

শেষাংশ

সিলেট শহরের দর্শনীয় স্থানগুলোর প্রত্যেকটি সামগ্রিক ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্যের সাথে। ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সাথে স্বতন্ত্র ভৌগলিক বৈশিষ্ঠ্যের মেলবন্ধনে দেশের অন্যান্য শহরগুলো থেকে নিমেষেই সিলেটকে আলাদা করে চেনা যায়। শহরের চাঞ্চল্য, মানুষের ভাষা, প্রথা ও জীবনধারণে আছে এক দারুণ স্বকীয়তা। ফলে অচিরেই সিলেট পরিণত হয় ভ্রমণপিপাসুদের আশ্রয়স্থলে। এই বিচিত্রতার সাক্ষী হতে শুধু বাংলাদেশিরাই নন; প্রতি বছর বিদেশি পর্যটকরাও ভিড় জমান এই আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রে।

পড়ুন: ঈদের ছুটিতে ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি এবং দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু সতর্কতা