সুনামগঞ্জে এমনিতেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। দু-এক দিনের মধ্যে ভারী বৃষ্টি শুরু হবে, আবার উজানের ঢল নামবে। তাই হাওরের ধান ৮০ শতাংশ পাকলেই সেগুলো দ্রুত কেটে তোলার অনুরোধ জানানো হচ্ছে কৃষকদের। বিষয়টি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে এবং কৃষি বিভাগের লোকজন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত জেলার হাওর ও নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। সকাল নয়টায় সুরমা নদীর পানির উচ্চতা ছিল চার দশমিক ৩৪ সেন্টিমিটার। একইভাবে জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও কিছুটা কমেছে। জেলায় ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে তিন মিলিমিটার।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেছেন, ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিল এই তিন দিন সুনামগঞ্জে ও ভারতের চেরাপুঞ্জি দুই জায়গাতেই ভারী বৃষ্টি হবে, নামবে পাহাড়ি ঢল। এতে দ্রুত নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
আরও পড়ুন: হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হবে: কৃষিমন্ত্রী
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক স্বপন কুমার বর্মণ (৬০) জানান, মানুষ হাওরের ফসল নিয়ে এমনিতেই চরম আতঙ্কে আছে। ফসল রক্ষা বাঁধগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। প্রশাসন থেকে দ্রুত ধান কাটার অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। কৃষকেরা এখন আধা পাকা ধানই কাটার চেষ্টা করছেন।
উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী বলেছেন, আমরা সংকটে আছি। একদিকে বৃষ্টি, ঢলের ভয়, অন্যদিকে জমিতে কাঁচা ধান। আমরা তো ধান কাটার জন্য বসে আছি। কিন্তু ধান না পাকলে কেটে তো লাভ নাই।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদি উর রহিম জাদিদ জানিয়েছেন, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তারা পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে একরকম লড়াই করে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু এখন আবার ঢল নামলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। কৃষকেরা ধান কাটছেন। একই সঙ্গে কৃষি বিভাগের লোকজন ২৯টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টর যন্ত্র নিয়ে মাঠে মাঠে আছেন। ১৫ দিন ধরে উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও বাঁধে ধস ও ফাটল দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আরেক দফা ঢল এলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তাই দ্রুত হাওরের ধান কাটার অনুরোধ জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।
তিনি বলেন, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জের সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটা নদ-নদীর কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব হাওরের ধান কেটে ফেলার জন্য বলা হচ্ছে। এ ছাড়া কোথাও যদি ফসল রক্ষা বাঁধে ফাটল দেখা দেয় অথবা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করতে বলেন তিনি।
আরও পড়ুন: টাঙ্গুয়ার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানির নিচে ১০০ একর ফসল
হাওর রক্ষায় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা হাওরের ফসল রক্ষায় দিনরাত কাজ করছি। এটা অন্য রকম এক যুদ্ধ বলা চলে। মাঝখানে পানি কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখন আবার বাড়বে, শঙ্কা কাটছে না। অনেক স্থানে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আবার ঢল এলে, পানির চাপ আরও বাড়লে, বাঁধগুলো ঠেকানো মুশকিল হবে। গত ৩০ মার্চ থেকে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জেলার সব হাওরের বোরো ফসল। গত ২ এপ্রিল প্রথমে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায়। এরপর একে একে ছোট-বড় আরও ১০টি হাওরের ফসলহানি ঘটেছে। তবে জেলার বড় হাওরগুলোর ফসলের এখনো ক্ষতি হয়নি।
জেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, এবার সুনামগঞ্জে দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ২২০ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত ধান কাটা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৫ হেক্টর জমির।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানিয়েছেন, জেলার বিভিন্ন হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মাঠে ধান কাটার যন্ত্রও আছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কৃষকেরা তাদের ফসল গোলায় তুলতে পারবেন।