বন্যপ্রাণী শিকার আইন প্রণয়নের পরও বন্ধ হচ্ছে না সুন্দরবনের হরিণ শিকার। মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে অনেক শিকারি হরিণ শিকার করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ হওয়ায় বনের ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে হরিণের মাংস-গুলিসহ এক ‘শিকারি’ আটক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের হরিণসহ সব বন্য সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোরভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবারও খুলনার কয়রা থেকে হরিণের ৫৩ কেজি মাংস উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (১৯ জুলাই) ভোরে উপজেলার ৪ নম্বর কয়রায় শাকবারিয়া খালের পাশে অভিজান চালিয়ে এ মাংস উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারী।
উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সব চেয়ে বেশি।
গত ৩ মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩২ কেজি হরিণের মাংস, একটি গলাকাটা হরিণ, ৫টি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন।
এ সময় মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬ জন। এ ছাড়া গত এক বছরে এর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি।
সম্প্রতি ৩ মণ হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল কয়রা উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বিচারে হরিণ নিধনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
জানা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই চিত্রা হরিণ। কিন্তু দিনের পর দিন প্রশাসনের রেড এলার্টসহ বিভিন্ন অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরিণ নিধন করে যাচ্ছে পাচারকারীরা।
আরও পড়ুন: ভোলায় ১৫ কেজি হরিণের মাংস জব্দ, গ্রেপ্তার ১
স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়েছে। এ কারণে হরিণ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনেকেই অগ্রিম ‘দাদন’নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা-শিকারিরা।
তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম, আবার কখনো মাংস এনেও বিক্রি করা হয়।
এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে হরিণ শিকার করছে একটি চক্র। এতে সুন্দরবনে দিন দিন কমে যাচ্ছে হরিণের সংখ্যা।
সম্প্রতি সময়ে হরিণ শিকার বেড়ে যাওয়া আমাদের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যেখানে বনদস্যু আটক হয়ে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হচ্ছে। সেখানে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার বেড়ে যাচ্ছে।
এর পেছনে বনবিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
এ ছাড়া যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।
অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন মাঝেমধ্যে দুই-একটা অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস।
এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, বিশেষত হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগের।
তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র্যাব, কোস্ট গার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম।
আরও পড়ুন: খুলনায় ১২০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ, আটক ১
মোহসিন বলেন, বনে জলদস্যুরাই বেশি হরিণ শিকার করে খেত। ২০১৮ সালে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় পর এবং গত কয়েক বছর রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বনে হরিণ শিকার কমেছে।
তা ছাড়া সাম্প্রতিক বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণার ফলে চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিতে উৎসাহিত হয়েছে।
এখন মাংসসহ হরিণ শিকারি বেশি ধরা পড়ছে।