দামামা বাজছে আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ ২০২২-এর। আগামী ১৬ অক্টোবর এ ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যাশিত উৎসবটির উদ্বোধনের অপেক্ষায় এখন গোটা পৃথিবী। যাদেরকে ঘিরে এই অনুষ্ঠানের এতো আবেগ-উৎকন্ঠা, সেই ১৬টি দলের মধ্যেও পুরোদমে চলছে প্রস্তুতির তোড়জোড়। সুপার ১২ পর্বের আটটি দলের তালিকায় ইতোমধ্যে নিজের নামটি উঠিয়ে নিয়েছে গর্বিত বাংলাদেশ। পুরো সুপার ১২ জুড়ে বাংলাদেশের একে একে খেলা হবে দক্ষিণ আফ্রিকা, প্রথম রাউন্ডের গ্রুপ বি বিজয়ী, ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে। কিন্তু এই ক্রিকেট লড়াইয়ে বাংলাদেশের অবস্থানটা ঠিক কোথায়? চলুন, বাংলাদেশ দলের সোয়াট (SWOT) বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা জেনে নেয়া যাক।
আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ ২০২২-এ বাংলাদেশ স্কোয়াড
বাংলা টাইগারদের টি-২০ বিশ্বকাপের এই অষ্টম আসরে যাত্রা শুরু হবে আগামী ২৪ অক্টোবর প্রথম রাউন্ডে গ্রুপের রানার্স-আপ দলের বিপক্ষে হোবার্টের ব্যালেরিভ ওভালে নামার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি ) কর্তৃক নির্ধারিত বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য ১৫ সদস্য বিশিষ্ট স্কোয়াডে থাকছে তিন জন ব্যাট্সম্যান, দুজন উইকেট কিপার, পাঁচ জন অল রাউন্ডার এবং পাঁচ জন বোলার। অভিজাত এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য থাকছেন বিশ্বমানের অল রাউন্ডার শাকিব আল হাসান। সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন নুরুল হাসান সোহান। ১৫ সদস্যের বাইরে অপেক্ষমান হিসেবে দলের সফর সঙ্গী হবেন সৌম্য সরকার, শরিফুল ইসলাম, রিশাদ হোসেন এবং মেহেদি হাসান।
মূল বিশ্লেষণে যাবার আগে চলুন এক নজরে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের এবারের স্কোয়াডটি দেখে নেয়া যাক।
সাকিব আল হাসান, তাসকিন আহমেদ, সাব্বির রহমান, মেহেদি হাসান মিরাজ, মুস্তাফিজুর রহমান, নাজমুল হোসেন শান্ত, আফিফ হোসেন, লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেন, ইয়াসির আলী, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, নুরুল হাসান, হাসান মাহমুদ, এবাদত হোসেন এবং নাসুম আহমেদ।
আরও পড়ুন: ত্রিদেশীয় সিরিজ: ৮ উইকেটের বড় হার বাংলাদেশের
২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সোয়াট (SWOT) বিশ্লেষণ
শক্তি (Strength)
অস্ট্রেলিয়ায় পেস বোলিং পিচের জন্য মুস্তাফিজ, তাসকিন, সাইফুদ্দিন, এবাদত এবং হাসানের বোলিং অর্ডারটা বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর সিডনি, ব্রিসবেন, অ্যাডিলেডের মত পিচের জন্য রীতিমত বুদ্ধিদ্বীপ্ত নির্বাচন বলা যেতে পারে। সুপার ১২ পর্বের দক্ষিণ আফ্রিকানদের জন্য ব্যাপারটি খুব আশ্চর্যজনক না হলেও, এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ দ্রুত গতি বোলিংয়ে দক্ষ হয়েছে।
অন্যদিকে, স্পিনারদের সংখ্যা লঘিষ্ঠতাটি পূরণ করে দিতে পারে অলরাউন্ডাররা। নাসুম, মিরাজ এবং শাকিবের সমর্থনে, আফিফ এবং মোসাদ্দেক বেশ ভালো স্পিন বুহ্য তৈরি করতে পারে।
এশিয়া কাপ স্কোয়াডের অন্যতম স্পিনার ছিলেন হলেন মাহেদী হাসান। কিন্তু এবার ১৫ তে তিনি জায়গা করে নিতে পারেননি। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের কোচ শ্রীরামের মতে নাসুম এবং মেহদির মাঝে অনায়াসেই অদল-বদল করা যায়। এবারো সে সুযোগ থাকায় নিদেনপক্ষে অফ-স্পিন নিয়ে বাংলাদেশকে তেমন মাথা ঘামাতে হবে না।
তাছাড়া বিশাল সাপোর্ট হিসেবে সাকিব তো থাকছেই। এবারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি সাকিব আর মুস্তাফিজু। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে উল্লেখযোগ্য চড়াই-উৎড়াই থাকলেও, দলে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অল-রাউন্ডার থাকা মানে এক বিরাট নির্ভরতা। যে কোন সময় ম্যাচের ভাগ্য বদলে দিতে পারেন ব্যাট ও বল উভয় হাতেই ম্যাচজয়ী এই ক্রিকেটার। অধিনায়কত্বের চাপ সামলিয়ে নিজের সেরাটা উপহার দিতে পারলে তিনি একাই যথেষ্ট সেমিফাইনাল পর্যন্ত দলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সাকিবের মতো মুস্তাফিজও বল হাতে ম্যাচজয়ী। তার মাঝারি পেস বোলিংয়ের নৈপুণ্যে তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানদের ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে দেখতে অভ্যস্ত তার ভক্তরা। এছাড়া তার কম ডেলিভারি দেয়া দ্রুত গতির বলগুলোও বেশ বিধ্বংসী হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ায় পিচে বল হাতে মুস্তাফিজের ঝলসে ওটা শুধু দর্শকদের জন্যই নয়; দলের জন্যও দারুণ চমক হতে পারে। সম্প্রতি কয়েকটি ম্যাচে তার যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। এর সঙ্গে ক্রিকেটপ্রেমিরা এও বুঝে গেছে যে যেকোন পরিস্থিতিতে দল তার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে।
সাইফুদ্দিন, মেহেদি ও আফিফরা ফুল ফর্মে থাকায় শাকিবের নেতৃত্বে চমৎকার কোয়াড্রুপলেট তৈরি হতে পারে ব্যাটিং ও বোলিং দুই ইনিংসেই। পাওয়ার প্লেতে তাদের সাম্প্রতিক বোলিং ও ব্যাটিং আক্রমণগুলো বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল।
আরও পড়ুন: ২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ: ভেন্যু ও প্রাইজ মানি
দুর্বলতা (Weakness)
মেধা বা অভিজ্ঞতা; বাংলাদেশের এর কোনটার কমতি আছে বলা হলে ভুল হবে। সাব্বির, মিরাজ, আফিফ, মোসাদ্দেক, লিটন দাস, তাসকিন আর এবাদতকে অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ একাদশে দেখা যাচ্ছে। তাই বেশ তরুণ হলেও তাদের কেউই অনভিজ্ঞ নন। তবে সমস্যা হলো এ দীর্ঘ সময়ে তাদের পারফরম্যান্স এখনো নির্দিষ্ট মাত্রায় এসে দাঁড়ায়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই অসংলগ্নতা বাংলাদেশ ক্রিকেটের চিরায়ত সঙ্গী।
প্রতিবারই দুর্দান্ত সূচনাকারি খেলোয়াররা নানা ধরনের আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলোতে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। সৃষ্টি হয়েছে ফুলেল সম্ভাবনার। অথচ এই সম্ভাবনাগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ পারফরম্যান্সে রূপান্তর হয়নি। আগে বলা হয়েছিল তাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। কিন্তু সেই অজুহাত এখন দেয়া যাবে না, কারণ তারা বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। দুর্ভাগ্যবশত প্রত্যেকেরই নামের পাশে দুয়েকটি সেরা ম্যাচ থাকছে, কিন্তু সেগুলোকে ছাপিয়ে সামনের খেলাগুলোতে তারা অধিক ভালো করা তো দূরে থাক; বিগত পারফরমেন্সটিই ধরে রাখতে পারছে না। ফলে ম্যাচ জিততে এখনও নির্ভর করতে হচ্ছে শুধু শাকিব ও মুস্তাফিজের ওপর।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তাদের ব্যাটিং অর্ডার। মুলত দলের প্রয়োজনের সময় টিকে থাকতে না পারলে পাহাড়সম স্ট্রাইক রেট কোনো কাজে আসে না। পাশাপাশি টাইগারদের স্পিনার ভীতি আছে। তাই তারা অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় বড় বাউন্ডারির সুবিধা নিতে পারবে না।
এশিয়া কাপ মিস করায় অস্ট্রেলিয়ায় টুর্নামেন্টের জন্য নাজমুল হোসেন শান্তকে ১৫ জনের দলে নিয়েছে বাংলাদেশ। ওপেনিং অর্ডারে তার দুর্দান্ত রেকর্ড নেই। আর সর্বসাকূল্যে ৯টি টি-২০ তে তার সংগৃহীত রানের গড় ১৮ দশমিক পাঁচ, যেখানে একটিও ৫০শের বেশি স্কোর নেই।
নুরুল হাসান এবং ইয়াসির আলী মিডল-অর্ডারে যোগ হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের কাছে ওপেনিং অর্ডারে বিকল্পের অভাব পড়ছে। নাজমুল অথবা এশিয়া কাপের সময়ের ন্যায় মিরাজ লিটন দাসের সঙ্গে ওপেন করতে পারে। কিন্তু তাতে নির্ভরযোগ্য কোনো ইনিংসের সূচনা হবে কিনা তা দেখার বিষয়।
নাজমুল বেশ ভালো বিকল্প, কিন্তু এশিয়া কাপে বাদ পড়ার কারণে বাংলাদেশের শীর্ষ একাদশে তার অবস্থানটা একটু নড়বড়ে হতে পারে। আর মূল স্কোয়াডের বাইরে থাকায় ওপেনার সৌম্য সরকারের কথা ভাবার কোনো অবকাশই নেয়।
আরও পড়ুন: আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ
সম্ভাবনা (Opportunity)
সাম্প্রতিক মাসের ম্যাচগুলোর কথা ধরা হলে দল হিসেবে বাংলাদেশ খুবই হতাশাজনক। তাদের জিম্বাবুয়ে সফরের অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল এবং আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে এশিয়া কাপ থেকে ফিরে আসাটা খুব ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড রাখেনি। সেই হিসেবে অবশ্য এবারে বিশ ওভারের বিশ্বকাপে সুপার ১২ স্টেজে তালিকাভুক্ত হওয়া বাংলাদেশের জন্য বিরাট পাওয়া।
কিন্তু দর্শকদের আকস্মিক চমকে দেয়াটা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। বরঞ্চ বাংলাদেশের বর্তমান দলটি সেই চমক দেয়ার জন্য পুরোদস্তুর ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। খেলার ফরম্যাট যখন ২০-২০, তখন আকাশচুম্বী স্ট্রাইক রেট আর বলের ভেল্কিতে ব্যাট্সম্যানকে ধরাশায়ী করাটাই আসল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জার্সি অনলাইনে বিক্রির পরিকল্পনা বিসিবির
হুমকি (Threat)
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ যে পারফরম্যান্স ধস হয়েছে তার একটি প্রধান কারণ হলো আত্মবিশ্বাসের অভাব। মাঠে নামাকালীন তাদের বিভ্রান্তিকর চেহারা শুধু তাদের ভক্তদেরই কষ্ট বাড়ায় না, অপর পক্ষের সমর্থকদেরও বুঝিয়ে দেয় যে তারা হয়ত চমকপ্রদ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে যাচ্ছে না। এছাড়া সমসাময়িক খেলাগুলোতে অধিনায়কত্ব নিয়ে বাড়তে থাকা জটিলতা এই সমস্যাগুলোকে আরও বেগবান করেছে।
বর্তমান সময়কার তাদের স্পিন বোলিংয়ের রেকর্ডগুলো ক্রমেই অবদমিত হচ্ছে। অন্যদিকে, প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক মানসিকতায় বাংলাদেশিদের নিজের জায়গায় শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। এ অবস্থায় বিশাল রানের টার্গেট তাদের ব্যাটিং অর্ডার সুসজ্জিত থাকলেও নিমেষেই ভেঙে গুড়িয়ে যেতে পারে।
আশা করা হচ্ছে যে তাসকিন, মুস্তাফিজ এবং সাইফুদ্দিন শীর্ষ একাদশে থাকবেন আর এই থাকাটা অবশ্যই তারা নিজের সেরাটা দিয়ে আরও মজবুত করবেন। কিন্তু তাদের কাছাকাছি সময়ের আন্তর্জাতিক ২০ ওভারের ইনিংসগুলো তেমন ভালো আশা দেখায় না।
আর বাংলাদেশি পেসারদের অস্ট্রেলিয়ার পিচ থেকে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হওয়া উচিত। তবে পৃথিবী কাঁপানো কিছু পাওয়ার হিটারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তাদের ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: আমাদের উন্নতি করতে হবে: সাকিব
পরিশিষ্ট
গত ৫ অক্টোবর এই বিশ্বনন্দিত স্পোর্টস ইভেন্টটির জন্য বাংলাদেশ দলের স্কোয়াডও ঠিক হয়ে গেলো। এবার শুধু মাঠে নামার পালা। ২০-২০ ওভারের দুই ইনিংসে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। পাশাপাশি এও ঠিক যে সারা পৃথিবীর কোটি জোড়া চোখ তাকিয়ে এই ২২ গজের মঞ্চে। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে বহুজাতির বিশ্বকাপ চলছে, সে চাপটিকেও সুনিপুনভাবে সামলানোর গুরুদায়িত্বটা পালন করতে হবে টাইগারদের। ২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সোয়াট (SWOT) বিশ্লেষণের নির্যাসে যে কথাটি উঠে আসে তা হচ্ছে পুরোনো অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যেতে হলে দলের প্রতিটি সদস্যের সম্মিলিত ভূমিকা অবধারিত।