সময় ঘনিয়ে এসেছে আইসিসি ২০ ওভারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের। নয়নাভিরাম দ্বীপদেশ অস্ট্রেলিয়ায় বসতে যাচ্ছে বিশ্বনন্দিত এই স্পোর্টস ইভেন্টের অষ্টম আসর। ২০২১ এর ১৫ নভেম্বর আইসিসি থেকে ২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ ভেন্যু নিশ্চিত করা হয়। আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ান অস্ট্রেলিয়াই এবার আয়োজন করবে পুরো ইভেন্টটি। ১৬ অক্টোবর, ২০২২ থেকে শুরু হয়ে ১৩ নভেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত চলবে এই ক্রিকেট উৎসব। আজকের নিবন্ধটিতে এই ভেন্যুগুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জানার সাথে সাথে আইসিসি পুরুষ টি-২০ ২০২২ বিশ্বকাপের প্রাইজ মানি সম্বন্ধেও আলোচনা করা হবে।

২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপের ৭টি ভেন্যু

মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, মেলবোর্ন

ধারণ ক্ষমতা: ১,০০,০২৪

১৮৫৩ সালে নির্মিত এমসিজি বা মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড দক্ষিণ গোলার্ধের বৃহত্তম এবং গোটা বিশ্বে ১০তম বৃহত্তম স্টেডিয়াম। এটি একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ স্টেডিয়াম, যা অস্ট্রেলিয়ান খেলাধুলার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে। এমসিজি-তে প্রথম ক্রিকেট ম্যাচটি খেলা হয় ১৮৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৮৫৬ সালের মার্চ মাসে প্রথম আন্তঃ-ঔপনিবেশিক ম্যাচে মুখোমুখি হয় ভিক্টোরিয়া ও এনএসডব্লিউ (নিউ সাউথ ওয়েলস)।

এমসিজি টেস্ট ক্রিকেট (১৮৭৭) এবং একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের (১৯৭১) জন্মস্থান। এছাড়া এএফএল গ্র্যান্ড ফাইনালের জন্য সব সময় এই ভেন্যুটি নির্ধারিত থাকে। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিক গেমস এবং ২০০৬ এর কমনওয়েলথ গেমস সহ বিভিন্ন বড় আন্তর্জাতিক স্পোর্ট্স ইভেন্ট ও কনসার্টের আয়োজন করেছে এমসিজি।

আরও পড়ুন: আইসিসি ওয়ানডে বর্ষসেরা দলে ৩ বাংলাদেশি ক্রিকেটার

লর্ডসের পর এমসিজিই হলো বিশ্বের একমাত্র স্টেডিয়াম, যেখানে একাধিকবার (১৯৯২ এবং ২০১৫) আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল আয়োজন করা হয়েছে। এবারের আইসিসি পুরুষ টি২০ বিশ্বকাপ আসরের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে এই মাঠে।

অ্যাডিলেড ওভাল, অ্যাডিলেড

ধারণ ক্ষমতা: ৫৫,৩১৭

অ্যাডিলেড শহরের গর্বিত এই কেন্দ্রবিন্দু খেলাধুলা, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ভরপুর একটি স্থান। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধনের জন্য এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি আছে। স্টেডিয়ামটির সবচেয়ে বড় সংস্কার হয়েছিলো ২০১৩ সালে। বর্তমানে এটি এএফএল(অস্ট্রেলিয়ান ফুটবল লিগ), ক্রিকেট, সকার, রাগবি লিগের স্বর্গ। এছাড়া অ্যাডেল, গান্স এন’ রোজেস, এবং দ্যা রোলিং স্টোন্সদের মত পৃথিবী কাঁপানো শিল্পীদেরও পদচারণার জায়গা এই ভেন্যুটি।

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া প্রায় ১৫০ বছর ধরে এখানে ক্রিকেট আয়োজন করে আসছে। কয়েক দশক জুড়ে অ্যাডিলেড ওভালের অর্জনে রয়েছে ২০১৭ এর প্রথম ডে-নাইট অ্যাশেজ টেস্ট সহ রেকর্ড-ব্রেকিং ম্যাচগুলো। এখানে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কিংবদন্তি স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের সম্মানে রয়েছে ব্র্যাডম্যান সংগ্রহ জাদুঘর।

আরও পড়ুন: আইসিসির ওয়ানডে বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মনোনয়ন পেলেন সাকিব

তাছাড়া রুফ ক্লাইম্বিং-এর জন্যও বিশ্ব পরিব্রাজকদের কাছে জায়গাটির বিশেষত্ব রয়েছে, কারণ এটি দর্শকদেরকে আকাশের একদম কাছাকাছি নিয়ে যায়। এখানে গাইডেড ক্রিকেট ওয়াকিং ট্যুরও পাওয়া যায়। এবারের আসরের ২টি সেমিফাইনালের একটির আয়োজন হবে এই ভেন্যুতে।

দ্য গাব্বা, ব্রিসবন

ধারণ ক্ষমতা: ৪২,০০০

১৮৯৬ সাল থেকে কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেটের যাবতীয় কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় এখন গাব্বা মানেই কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেট। তবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি শেফিল্ড শিল্ড ম্যাচ আয়োজনের জন্য ক্রিকেট বিশ্বে এর সুপরিচিতি আছে। এটি ঐতিহ্যগতভাবে অস্ট্রেলিয়ান গ্রীষ্মের প্রথম টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করে। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যোগদানকারী ভক্তদের জন্যও যে এটি উষ্ণ ও প্রাণবন্ত পরিবেশ প্রদান করবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। শক্ত ও বাউন্সিং পিচের জন্য ক্রিকেট বোদ্ধাদের প্রথম পছন্দ থাকে এই গাব্বা। 

সেই সূত্রে, এখানে অনুষ্ঠিত দ্রুতগামী টি-২০ ম্যাচগুলোতে ব্যাটিং-এর কি অবস্থা হবে তার জন্য ক্রিকেটপ্রেমিদের কৌতূহল বাড়ছে।

আরও পড়ুন: আইসিসি ক্রিকেট কমিটির প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলি

কার্ডিনিয়া পার্ক, জীলং

ধারণ ক্ষমতা: ২৬,০০০

ভিক্টোরিয়ার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক এই স্টেডিয়ামটির আরেক নাম হলো জিএমএইচবিএ (জীলং মেডিকেল এবং হাসপাতাল বেনিফিটস অ্যাসোসিয়েশন) স্টেডিয়াম। ভেন্যুটির সাম্প্রতিক পুনর্বিন্যাস এটিকে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় আঞ্চলিক ভেন্যুগুলোর একটিতে পরিণত করেছে। পাশাপাশি একটি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট সুবিধা প্রদানের জন্য এর প্রস্তুতিপর্বও শেষ হয়েছে।

১৯৪১ সালে নির্মিত হওয়া এই স্টেডিয়ামটি এএফএলের পক্ষে জীলং ক্যাটস এবং অন্যান্য অনেক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সাক্ষী হয়ে আছে।

কার্ডিনিয়া পার্ক প্রিসিনক্টের প্রাণকেন্দ্র এই স্পোর্টস ভেন্যুটি, যেখানে নেটবল ও সুইমিং পুলের ব্যবস্থা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কার্ডিনিয়া পার্ক তার বার্ষিক ইভেন্টের অংশ হিসেবে বিগ ব্যাশ লিগ, আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচ, সকার ফ্রেন্ডলি, সুপার রাগবি এবং নাইট্রো সার্কাসের আয়োজন করেছিলো।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জার্সি অনলাইনে বিক্রির পরিকল্পনা বিসিবির

বেলেরিভ ওভাল, হোবার্ট

ধারণ ক্ষমতা: ২০,০০০

সিডনির যেমন ব্যালমেইন, মেলবোর্নের যেমন উইলিয়ামসটাউন, পার্থের যেমন ফ্রেম্যান্টল, ঠিক তেমনি হোবার্টের আছে বেলেরিভ।

ডারওয়েন্ট নদীর রৌদ্রোজ্জ্বল পূর্ব তীরে মাঠটি কেন্দ্রীয় হোবার্টের গুঞ্জনপূর্ণ জলপ্রান্তর থেকে গাড়ি ড্রাইভিং বা ফেরি যাত্রায় মাত্র ১০ মিনিটের পথ। ১৯১৪ সালে বেলেরিভ ওভালে প্রথম আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। ওভালটি বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন চিত্তকার্ষক সংযোজনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। যেমন রিকি পন্টিং স্ট্যান্ডটি ২০১৫ সালে আইসিসি পুরুষ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় খোলা হয়েছিল।

বর্তমানে এখানকার গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ এবং শীতকালে এএফএল ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হয়। ভ্রমণকারীরা এখানকার তাসমানিয়ান ক্রিকেট মিউজিয়ামটি দেখে যেতে ভোলেন না। কারণ এখানে এক নজরে দেখে নেয়া ও জেনে নেয়া যায় বিশ্বসেরা অস্টেলিয়ান ক্রিকেটারদের সম্বন্ধে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জার্সি উন্মোচন বিসিবির

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, সিডনি

ধারণ ক্ষমতা: ৪৮,৬০১

১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিনোদনের ঐতিহ্যের ধারক এসসিজি বা সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। প্রায় প্রতিটি বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার এই ঐতিহাসিক ময়দানটিতে তার পদধূলি দিয়েছেন। সিডনির পূর্ব শহরতলি ও কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক জেলা সংলগ্ন সিডনির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এসসিজির অবস্থান।

এসসিজি এনএসডব্লিউ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্যাডিংটনের ভিক্টোরিয়া ব্যারাকের পিছনে ১৮৫২ সালের সাবেক গ্যারিসন গ্রাউন্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এসসিজি বিশ্বের অন্যতম প্রধান ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে অত্যন্ত সম্মানিত, যেখানে বার্ষিক নববর্ষের টেস্ট, একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করা হয়। এছাড়াও এটি এনএসডব্লিউ ব্লুজ এবং সিডনি সিক্সার্সের যাবতীয় কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র। এবারের টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ২টি সেমিফাইনালের ১টি অনুষ্ঠিত হবে এই মাঠে।

পার্থ স্টেডিয়াম, পার্থ

ধারণ ক্ষমতা: ৬১,২৬৬ 

২০১৮ এর ২১ জানুয়ারি স্টেডিয়ামটি আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা হয়েছিল। এই স্টেডিয়ামটি পার্থ সিবিডির পূর্বে বারসউড উপদ্বীপে অবস্থিত। পশ্চিমে চোখে পড়বে মনোরম সোয়ান নদী ও পার্থ শহরের দৃশ্য। বহুমুখী এই স্টেডিয়ামটি এএফএল, আন্তর্জাতিক ও বিগ ব্যাশ লিগ ক্রিকেট, সকার, রাগবি লিগ সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা এবং ইউনিয়ন প্লাস কনসার্টের মত বিনোদনমূলক ইভেন্টের আশ্রয়স্থল।

আরও পড়ুন: বিপিএল: ‘বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা’ থেকে ‘সেরা ঘরোয়া’ লিগ

২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ প্রাইজ মানি

এখানে সমস্ত পুরস্কৃত অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশি টাকায় যার কনভার্শন রেট ১০১ দশমিক ৩৫ টাকা (২ অক্টোবর, ২০২২)।

পুরো স্পোর্টস ইভেন্টের চূড়ান্ত বিজয়ীরা পাবেন ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের প্রাইজ মানি, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ১৬ কোটি টাকারও বেশি। রানার্স-আপ টিমকে দেয়া হবে ৮ লাখ ডলার অর্থাৎ ৮ কোটি টাকার বেশি। আর সেমিফাইনালে হেরে যাওয়া দুই প্রতিপক্ষকে ৪ লাখ ডলার বা ৪ কোটি টাকার অধিক মূল্যের অর্থ পুরস্কার দেয়া হবে।

সুপার-১২ পর্বের ৩০ টি ম্যাচের বিজয়ীরা পাবেন ৪০ হাজার ডলার বা ৪০ লাখ টাকার বেশি। এই পর্ব থেকে যে দলগুলো ছিটকে যাবে তাদের প্রত্যেককে ৭০ হাজার ডলার বা ৭০ লাখ টাকার বেশি দেয়া হবে।

আরও পড়ুন: নারী ক্রিকেট নিয়ে ব্যর্থতা স্বীকার করল পাপন

রাউন্ড-১ জয়ের সময় এবং স্টেজ চলাকালীন ১২টি ম্যাচে প্রতিটি টিম ৪০ হাজার ডলার বা ৪০ লাখ টাকারও বেশি মূল্যের পুরস্কারে ভূষিত হবে। প্রথম রাউন্ডে ছিটকে যাওয়া চারটি দল ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার বা ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকারও বেশি প্রাইজ মানি নিয়ে ঘরে ফিরবে।

সামগ্রিকভাবে টুর্নামেন্টের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৫৬ কোটিরও বেশি টাকা, যা অংশগ্রহণকারী ১৬টি দলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে।

শেষাংশ

৭ টি ভেন্যুতে আয়োজিত ২০২২ আইসিসি পুরুষ টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসর উদযাপনের মধ্য দিয়ে সব বয়সী এবং সব ধরনের মানুষকে একত্রিত করবে। আয়োজক শহরগুলো হলো- অ্যাডিলেড, ব্রিসবেন, জিলং, হোবার্ট, মেলবোর্ন, পার্থ ও সিডনি। টি-২০ ক্রিকেটের গতিশীল প্রকৃতি নিমেষেই ক্রিকেট ভক্তদেরকে তাদের চূড়ান্ত বিশ্বকাপ অভিজ্ঞতা সরবরাহ করবে। এছাড়াও ক্রিকেট বিশ্বের বড় বড় সুপারস্টারদের বিধ্বংসী পারফরমেন্স দেখার জন্য এর থেকে বড় ক্রীড়া উৎসব আর হতে পারে না।

আরও পড়ুন: নারী এশিয়া কাপ: ভারতকে ১৩ রানে হারাল পাকিস্তান|