২০০৩ সালের পর এবারই প্রথম বিশ্ব ফুটবলের সেরা ব্যক্তিগত পুরস্কার ব্যালন দ’রের জন্য মনোনীত ৩০ ফুটবলারার সংক্ষিপ্ত তালিকায় নেই লিওনেল মেসি ও ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর কেউ। ফলে ফুটবলের নতুন যুগের শুরুতে কে বা কারা হবেন পোস্টার বয়, এ বছরের ব্যালন দ’র জেতার মাধ্যমেই তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আগামী ২৮ অক্টোবর প্যারিসে জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভোটে এই পুরস্কার বিজয়ী নির্বাচিত হয়ে থাকে।
রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়ন লিগ জেতার পর ব্যালন দ’র জয়ের পর সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ক্লাবটির ফরোয়ার্ড ভিনিসিউস জুনিয়র ও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার জুড বেলিংহ্যাম। তবে ইউরোতে ইংল্যান্ড টেনেটুনে ফাইনালে উঠে স্পেনের কাছে হারের পর বেলিংহ্যামের নাম পরবর্তীতে ফিকে হয়ে গেছে।
এছাড়া ঘরোয়া লিগে অসাধারণ পারফর্ম করেছেন আরও বেশ কয়েকজন। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আর্লিং হালান্ড, হ্যারি কেইনের মতো তারকারা রয়েছেন এই কাতারে। তবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তাদের কেউই নজর কাড়তে না পারায় পরিসংখ্যানে এগিয়ে থাকলেও ব্যালন দ’রের লড়াই তারা বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়বেন বলেই মনে হয়।
আরও পড়ুন: ২১ বছর পর ব্যালন দ’র লড়াইয়ে নেই মেসি-রোনালদো
এদের মধ্যে কিলিয়ান এমবাপ্পের নাম আসে সবার আগে। পিএসজিতে থাকাকালে গত মৌসুমে ৫২ গোল ও ২১টি অ্যাসিস্ট করেছেন চলতি মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া এই স্ট্রাইকার। জিতেছেন লিগ-১, ফেঞ্চ কাপ ও ফরাসি সুপার কাপ। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন লিগের সেমিফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে হেরে পিএসজির বিদায় নেওয়ার পর ইউরোতেও সেমিফাইনালে হারে এমবাপ্পের ফ্রান্স। এছাড়া নাকে আঘাত লেগে অসুস্থ থাকায় ইউরোয় তার পারফরম্যান্সও ছিল সাদামাটা।
বায়ার্ন মিউনিখের হ্যারি কেইনও গত মৌসুমে করেছেন ৫২ গোল, সেই সঙ্গে ১৪টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তার নামের পাশে। কিন্তু গাদা গাদা গোল করেও বায়ার্নকে বুন্দেসলিগা জেতাতে পারেননি এই স্ট্রাইকার। শুধু বুন্দেসলিগা কেন, ঘরোয়া-চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মিলিয়ে গত মৌসুমে জার্মান জায়ান্টদের কোনো ট্রফিই জেতাতে পারেননি কেইন। এরপর টুর্নামেন্টজুড়ে বিবর্ণ ফুটবল খেলে ইউরোর ফাইনালে উঠলেও সেখানে স্পেনের কাছে হেরে হতাশ হতে হয় ইংল্যান্ড অধিনায়ককে।
তাদের মতো আরও একজন ম্যানচেস্টার সিটির নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হালান্ড। ৪৫ গোল, ৬ অ্যাসিস্টের মাধ্যমে গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হন তিনি। এছাড়া ইউরো বাছাইপর্বই উৎরাতে ব্যর্থ হয়েছে হালান্ডের নরওয়ে। ফলে প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুট জিতলেও জাতীয় দলের জার্সিতে প্রাপ্তির খাতায় কিছুই না থাকায় ব্যালন দ’র প্রতিযোগিতায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়বেন তিনি।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এবারের ব্যালন দ’র জয়ের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলীয় ফরোয়ার্ড ভিনিসিউস জুনিয়র, ক্লাবটির স্প্যানিশ অধিনায়ক দানি কারভাহাল, ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ অধিনায়ক রদ্রি এবং ইন্টার মিলানের আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড লাউতারো মার্তিনেস।
ভিনিসিউস জুনিয়র
গত মৌসুমে লা লিগা, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতায় এবারের ব্যালন দ’র জয়ের দৌঁড়ে ভিনিসিউসকে অনেকেই এগিয়ে রাখছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে দলের ২-০ ব্যবধানের জয়ে একটি গোল ছিল তার। পাশাপাশি মোট ৬ গোল করে টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি।
আরও পড়ুন: ব্যালন দ’র: ভিনিসিউস, বেলিংহ্যামকে ফেভারিট মনে করেন না কারভাহাল
২০২৩-২৪ মৌসুমে লা লিগায় ভিনিসিউসের গোলসংখ্যা ১৫টি। এছাড়া স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে ৪-১ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন তিনি। সব মিলিয়ে গত মৌসুমে ২৬ গোল ও ১২টি অ্যাস্টি করেছেন এই উইঙ্গার।
তবে ক্লাবের হয়ে আলো ছড়ালেও জাতীয় দলের জার্সিতে মোটেও ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি ভিনিসিউস। সর্বশেষ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় ভিনির ব্রাজিলকে।
দানি কারভাহাল
সেদিক থেকে হিসাব করলে ব্যালন দ’রের দৌড়ে এগিয়ে থাকার কথা ভিনিসিউসেরই ক্লাব সতীর্থ দানি কারভাহালের। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ভিনির সমপরিমাণ ট্রফি জেতার পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কারভাহাল। ফুটবলের পাশাপাশি রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন ৩২ বছর বয়সী এই উইংব্যাক।
ডিফেন্ডার হয়েও গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সব মিলিয়ে ৪১ ম্যাচে ৭টি গোল ও ৮টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তার নামের পাশে।
লাউতারো মার্তিনেস
দলীয় ও ব্যক্তিগত অর্জনের হিসাব ধরলে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন লাউতারো মার্তিনেস। ইতালির ঘরোয়া ফুটবলে সেরি-আ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তার ইন্টার মিলান। লিগে ৩৩ ম্যাচ খেলে ২৪ গোল ও ৬টি অ্যাসিস্ট করেছেন এই আর্জেন্টাইন। সেরি-আয় গত মৌসুমের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি লিগের গোল্ডেন বুটও (সর্বোচ্চ গোলদাতা) জিতেছেন তিনি। এ ছাড়াও ইন্টারের হয়ে গত মৌসুমে ইতালিয়ান সুপার কাপ জিতেছেন মার্তিনেস।
এরপর জাতীয় দলের জার্সিতে আর্জেন্টিনার টানা দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা জয়ে তার ছিল বড় ভূমিকা। ফাইনালে ২৭ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের একমাত্র গোলেই চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে জেতেন কোপা আমেরিকার গোল্ডেন বুটও।
সব মিলিয়ে গত মৌসুমে ৫৮ ম্যাচে ৩৫ গোল ও আটটি অ্যাসিস্ট করেছেন এই আর্জেন্টাইন।
রদ্রি
এবারের ব্যালন দ’রের লড়াইয়ে সমানে টক্কর দেবেন রদ্রিও। গত মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেছেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে গেলেও মাঠের খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী ভিনিসিউসের দলের বিপক্ষে দারুণ পারফর্ম করেন এই কন্ট্রোলিং মিডফিল্ডার। ওপেন প্লেতে ড্র করে শেষে টাইব্রেকারে রিয়ালের কাছে হারে সিটি।
আরও পড়ুন: রদ্রির ব্যালন দ’র নিশ্চিত হয়ে গেছে
এরপর স্পেনের জার্সিতে ইউরো আসরজুড়ে আলো ছড়ান ২৮ বছর বয়সী এই ফুটবলার। ইউরোর সাত ম্যাচের সাতটিই জিতে স্পেনকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করতে মূলত নাবিকের ভূমিকা পালন করেন রদ্রি।
প্রতিটি ম্যাচের রাশ তার হাতে দিয়েছিলেন কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তে, আর নিখুঁতভাবে ম্যাচের গতি কমানো-বাড়ানো, চুলচেরা সব পাস, বল দখলে দলকে নেতৃত্ব দেওয়াসহ প্রতিপক্ষের পাল্টা আক্রমণগুলো মাঝমাঠেই নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে স্পেনকে রেকর্ড চতুর্থবারের মতো ইউরো চ্যাম্পিয়ন করতে মাঝমাঠে সতীর্থ ও প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ওপর ছড়ি ঘোরান তিনি। তাই এবারের ব্যালন দ’রের ভোটে তাকে নির্বাচিত না করতে সাংবাদিকদের যে ঘাম ছুটবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত।
সর্বোপরি, পরিপূর্ণ একটি মৌসুম কাটাতে পারেননি ফেভারিটদের কেউই। কেউ ক্লাব ফুটবলে নজর কাড়লেও কেউ কেড়েছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে। আবার ঘরোয়া টুর্নামেন্টে কেউ দাপট দেখালেও অন্যজন দেখিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। কেউ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ঘরোয়া ফুটবল মাতালেও জাতীয় দলের জার্সিতে তার অর্জন নেই বললেই চলে, যেখানে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে না পারলেও ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে অন্যজন ছিলেন অসাধারণ। ফলে শিরোপা জয়ের পাশাপাশি মাঠের খেলায় কে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছেন, তা বিবেচনায় নিয়েই এ বছরের সেরা ফুটবলার নির্বাচন করতে হবে ভোটারদের। আর এক্ষেত্রে ফেভারিট যে কারও হাতে ব্যালন দ’র উঠলেই অবাক না হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকবে।