রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এক শতাংশের জন্যও সাধারণ মানুষ দায়ী নয়। বরং বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা স্বেচ্ছায় ফেরত না দেয়ার অভিপ্রায়েই ঋণ নিয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, ‘তারা ঋণ নেয় (ইচ্ছা করে) পরিশোধ না করার জন্য। অবশ্য এর সঙ্গে কিছু ব্যাংকারও জড়িত।’
শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ষষ্ঠ সমাবর্তনে তিনি এসব কথা বলেন।
বর্তমানে দেশের ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দেশে এখন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৩৬ লাখ কোটি টাকা।
শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ উল্লেখ করে হামিদ বলেন, কেউ হবে রাজনীতিবিদ, কেউ হবে ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি, কেউ হবে আমলা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘মনে রাখবেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি দেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায়। তা করতে ব্যর্থ হলে দেশ ও জাতির জন্য চরম বিপদ ডেকে আনে।’
আরও পড়ুন: বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময়
সার্কভুক্ত একটি দেশের অর্থনীতির দেউলিয়া অবস্থার সংবাদের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার জন্য আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের অশুভ সম্পর্ক যেকোনো দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।’ তবে তিনি কোনও দেশের নাম বলেননি।
প্রতিটি শিক্ষার্থীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এসব শিক্ষার মূল ক্ষেত্র।
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজকের রাজনীতিতে ক্ষমতা এবং অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির ভূমিকা পালন করে। ছাত্র রাজনীতিতে এসব অশুভ ছায়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অধিগ্রহণ ও চাঁদাবাজির কারণে ছাত্র রাজনীতিকে এখন আগের মতো সম্মানের পরিবর্তে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো নয়।’
ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করে হামিদ বলেন, তারা নৈতিকতা বাদ দিয়ে ব্যবসা শুরু করে কীভাবে রাতারাতি ধনী হওয়া যায় তা চিন্তা করেন।
হামিদ বলেন, একই কথা সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। চাকরি করার পর কীভাবে দ্রুত গাড়ি ও বাড়ির মালিক হবেন তা নিয়েই তারা চিন্তিত।
তিনি বলেন, ‘তারা ভুলে যায় যে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং জনগণের সেবক। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে তারা মাঝে মাঝে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করতে দ্বিধা করে না।’
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে দুর্নীতি অন্যতম বড় বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং শিক্ষকদেরও দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত রাখতে হবে।
হামিদ বলেন, কিছু উপাচার্য ও শিক্ষক আইনের অপব্যবহার করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজস্ব পরিচয় তৈরি করুন: এনডিসি স্নাতকদের রাষ্ট্রপতি
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইনের অপব্যবহার করে এমন একটি বিভাগ তাদের সুযোগ-সুবিধা পেতে খুব ব্যস্ত। তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রদের ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না।’
তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে কোনোভাবেই আপস করা যাবে না এবং শিক্ষার্থীরা একাডেমিক সব কার্যক্রম ঠিক রেখে রাজনীতি, সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে আপস করে অ-একাডেমিক কর্মকাণ্ডে বেশি সময় দেয়া হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বের প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সার্টিফিকেটভিত্তিক শিক্ষা দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম থেকে ৪৭তম ব্যাচের ৩১ হাজার ৭১৬ জন যোগ্য স্নাতকের মধ্যে মোট ১৫ হাজার ২১৯জন অনার্স, মাস্টার্স, এম ফিল, পিএইচডি, এমবিএ ডিগ্রি এবং উইকএন্ড কোর্সের অধীনে নিবন্ধন করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে ১৫ জন স্নাতককে আসাদুল কবির স্বর্ণপদক এবং শরাফুদ্দিন স্বর্ণপদক দেয়া হয় তাদের অসাধারণ একাডেমিক ফলাফলের জন্য।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন ১৯৯৭ সালে, দ্বিতীয়টি ২০০১ সালে, তৃতীয়টি ২০০৬ সালে, চতুর্থটি ২০১০ সালে এবং পঞ্চম সমাবর্তন ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়োপযোগী কারিকুলাম প্রণয়নের নির্দেশ রাষ্ট্রপতির