তারা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি সত্যিই বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কালো মেঘ ডেকে এনেছে, তবে মেঘের মধ্যেই রোদ থাকে, যা বাংলাদেশকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
কসমস সংলাপের অংশ হিসেবে শুক্রবার দেশে-বিদেশে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘ইমপেক্ট অব কোভিড-১৯ অন বাংলাদেশ: প্রগনোসিস ফর রিকভারি’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারের আয়োজন করে কসমস গ্রুপের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান কসমস ফাউন্ডেশন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান। এতে সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস) প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।
ওয়েবিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার, শিক্ষাবিদ ও প্রখ্যাত সমাজকর্মী রাশেদা কে চৌধুরী, ইউনির্ভাসিটি অব ডেনভারের জোসেফ কোরবেল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অর্থনীতির বিশিষ্ট অধ্যাপক হায়দার এ খান, বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এবং সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সামিট হোল্ডিংস লিমিটেড এবং আইপিসিও ডেভলপমেন্টস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান অংশ নেন।
আলোচকরা বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি, নারী, শিক্ষা, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব, তৈরি পোশাক খাত এবং দেশের অবকাঠামো ক্ষেত্রে ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং পুনরুদ্ধারের প্রাক্কলন নিয়ে আলোচনা করেন।
এতে সমাপনী বক্তব্য দেন কসমস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাহার খান।
ক্রমান্বয়ে পুনরুদ্ধার:
ধীরে ধীরে এ পরিস্থিতির পুনরুদ্ধার হবে উল্লেখ করে ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এটি সতিই বিশ্বব্যাপী এক বিপর্যয়। এটি এক পাহাড় যা আমাদের আরোহণ করতে হবে।’
যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে রূপান্তরিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, এটি বিশ্বব্যাপী মহামারি এবং বাংলাদেশ সরকার কোনো সময় নষ্ট না করেই এতে খুব দ্রুত সাড়া দিয়েছিল।
তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর করোনার প্রভাব তুলে ধরেন। কারণ বিশ্ব অর্থনীতির সাথে দেশের অর্থনীতি সুসংহত।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এখন অনেক বেশি আর্থিক সংস্থান এবং নগদ টাকা স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে, কারণ অনেক মানুষের তা প্রয়োজন হবে, যাতে ‘নীতিনির্ধারকরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন’।
পুনরুদ্ধারের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিকভাবে কী চলছে তা দেখা দরকার। তিনি উল্লেখ করেন যে ‘ভারসাম্যহীন’ প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হতে পারে না।
জায়েদী সাত্তার রপ্তানি বৈচিত্র্য, আরও বিনিয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট খাতের জন্য ভারসাম্যমূলক প্রণোদনা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
ড. রুবানা বলেন, এটি প্রায় দুঃস্বপ্নের মতো ছিল এবং ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর তাদের যাত্রা খুবই সংকটপূর্ণ ছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে বাতিল বা স্থগিত হওয়া আদেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ তারা পুনরুদ্ধার করেছেন, তবে অর্থ প্রদানের শর্ত এখনও অস্পষ্ট।
বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ:
সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, সামিট হোল্ডিংস লিমিটেড এবং আইপিসিও ডেভেলপমেন্টস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মো. আজিজ খান বলেছেন, করোনাভাইরাস পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের জন্য অনেক সুযোগ আসবে যেগুলো ব্যবহার করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, বর্তমানে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে ও এখানে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোকে উৎসাহিত করবে।
আজিজ খান আরও বলেন, ‘পোশাক আমদানিকারকদের সাথে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে যা একটি মৌলিক পণ্য। আমাদের আরও ভালো চুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
দেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের বর্ণনা দিয়ে আজিজ খান বলেন, বাংলাদেশ এখন ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এছাড়া পদ্মা সেতু এবং তিনটি বন্দর আসছে যা দেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সংযুক্ত করবে।
মেট্রো রেল, আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলের মতো প্রকল্পগুলো কার্যকর হয়ে গেলে তা দেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আফ্রিকার অনেক দেশেই বন্দরের সুবিধাগুলো নেই, যার জন্য তাদের অনেক ক্ষতি পোহাতে হয়। তবে বাংলাদেশের সে সুযোগ রয়েছে।’
আজিজ খান বলেন, সরকারের উচিত অবকাঠামোগত পোর্টফোলিও খতিয়ে দেখা যাতে সেগুলো দ্রুত কার্যকর করা যায়।
দেশের আর্থিক অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে দেশ এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে।
আজিজ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের বড় আমদানি বিদ্যুত এবং করোনা পরবর্তী যুগে এর ব্যয় অর্ধেক হবে। আগে যদি আমাদের ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হতো, এখন সেখানে আমাদের প্রয়োজন হবে ২ বিলিয়ন ডলার।’
‘তাই এ খাতে আমি বড় সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি,’ যোগ করেন তিনি।
শিক্ষা খাত বিষয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, এটি এখন ইন্টারনেট সংযোগের ওপর বেশি নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, দেশে গত ১২ বছরে ৭০ হাজার কিলোমিটার অপটিকাল ফাইবার নেয়া হয়েছে এবং আরও ভালো সংযোগ দেয়ার জন্য এটি থ্রিজি এবং ফোরজি এবং ফাইভজি’তে উন্নীত করা যেতে পারে।
‘আমরা যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সঠিকভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি তবে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। চীন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কারণ তাদের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষিত,’ যোগ করেন তিনি।
আজিজ খান বলেন, বাংলাদেশে মাথাপিছু চিকিৎসক এবং হাসপাতালের সংখ্যা কম।
সরকার এখন সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে চাইছে যা সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে, উল্লেখ করেন তিনি।
আজিজ খান বলেন, কোভিড-১৯ অবশ্যই সবার জন্য খারাপ তবে এ সুযোগগুলো অন্ধকারে তারার মতো।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব:
অধ্যাপক হায়দার খান বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন।
তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সময়োপযোগী এবং কৌশলগত সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাকে ‘ভারসাম্য’ বলা হয়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি খুবই স্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক বিষয় যে বাংলাদেশ ভূমি দিয়ে জমি নিয়ে তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত।
‘আমাদের আরও একটি প্রতিবেশী দেশ রয়েছে- মিয়ানমার, যারা সব সময় আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। এরপরই আমাদের বঙ্গোপসাগর রয়েছে তবে আমরা বঙ্গোপসাগরের বেশিরভাগ অংশই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না এবং আমাদের এটিও মনে রাখা উচিত’, যোগ করেন হায়দার খান।
মূলত বেশ কয়েকটি ব্যালেন্সিং শক্তি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ রয়েছে তবে আমি বলব, চীন এবং জাপান আমাদের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত উদীয়মান শক্তি চীন।’
ডিজিটাল বিভাজন:
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের মধ্যে শিক্ষাগত ঘাটতির কথা তুলে ধরে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন ড. রাশেদা।
তিনি বলেন, ‘এর জন্য একটি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রয়োজন। বিনিয়োগ থাকতে হবে এবং আমাদের ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনতে হবে।’
ড. রাশেদা আরও বলেন, করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পরে টেলিভিশন পাঠ, অনলাইন ক্লাস, রেডিও সম্প্রচার এবং মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে সরকার শিক্ষার ক্ষতি হ্রাস করার চেষ্টা করছে।
‘(প্রচেষ্টা সত্ত্বেও) আমরা নারী ও জাতিগত সংখ্যালঘুসহ বিপুল সংখ্যক পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি’, যোগ করেন তিনি।
শিক্ষামূলক কার্যক্রমের অভাবে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে পারে বলে সতর্ক করেন ড. রাশেদা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ ও চাহিদা শৃঙ্খলা উভয় ক্ষেত্রে একযোগে বিঘ্ন ঘটছে বলে নিজ পর্যবেক্ষণের কথা জানান কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান।
তিনি বলেন, করোনা পরবর্তী যুগের বিশ্ব ভিন্ন হবে এবং বিভিন্ন উপায়ে সংকট পুনরুদ্ধার হবে।
নাহার খান বলেন, কোভিড-১৯ একটি অব্যাহত চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে যা প্রতিনিয়ত মোকবিলা করার প্রয়োজন পড়বে।
কসমস ফাউন্ডেশন করোনাভাইরাস ইস্যুতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করবে বলে জানান তিনি।