দুর্যোগ ও যুদ্ধে নিহতদের লাশ সম্পর্কে প্রায়ই ভিত্তিহীন ভয় ও ভুল ধারণা থাকে। তাই এসব ঘটনায় নিহতদের লাশ নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করার জন্য সমাজের মানুষের মাঝে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও তথ্য নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
শুক্রবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য রেডক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি), ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেড ক্রস (আইসিআরসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যুদ্ধ ও দুর্যোগে বেঁচে যাওয়া মানুষদের সাহায্য করার অংশ হিসেবে এ আহ্বান জানিয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সশস্ত্র সংঘর্ষে যখন অনেক মানুষ মারা যায়, তখন এই লাশের উপস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের জন্য কষ্টকর।
কেউ কেউ দ্রুত এসব লাশ দাফনের জন্য এগিয়ে আসে। দুর্দশা কমানোর জন্য অনেকে গণকবর দেয়। কারণ ধারণা করা হয়, এই লাশগুলো স্থানীয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যগত হুমকির কারণ হতে পারে।
তবে এই সংস্থাগুলো বলেছে, এই ধরনের কাজ কিছু মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও জনগণ যদিও লাশগুলো দ্রুত কবর দেওয়ার জন্য প্রচুর চাপের মধ্যে থাকে, তবে লাশ অব্যবস্থাপনার ফলে নিহতের পরিবারের সদস্যেরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক কষ্টের পাশাপাশি সামাজিক ও আইনি সমস্যায় পড়ে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের হারের উর্ধ্বগতি, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান ডব্লিউএইচও’র
সু-পরিচালিত কবরস্থান বলতে যেখানে সহজে শনাক্তযোগ্য এবং সঠিকভাবে নথিভুক্ত কবরকে বোঝায়।
সংস্থাগুলোর তৈরি নির্দেশিকা অনুযায়ী, বিশেষ করে আইসিআরসি/আইএফআরসি/ডব্লিউএইচও ম্যানুয়াল ফর দ্য ডেড অব দ্য ডিজাস্টারস আফটার ম্যানেজমেন্ট অনুযায়ী প্রতিটি লাশের সঠিক অবস্থান এবং সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্য ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিশ্চিত করা উচিত।
লাশ সঠিকভাবে শনাক্ত করার আগে সমাহিত বা দাহ করা উচিত নয়।
লাশের আরও ভালো ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করার জন্য সংস্থাগুলো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সরঞ্জাম সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে তারা প্রয়োজনে (যখন একসঙ্গে অনেক লাশ দাহ বা সমাহিত করতে হয়) লাশ কবর দেওয়ার মতো কাজ করতে সহায়তা করতে পারে।
লিবিয়ায় রেডক্রস ও ডব্লিইএইচও টিম সরাসরি কর্তৃপক্ষ, সম্প্রদায় ও লিবিয়ান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সঙ্গে কাজ করছে। তাদের নির্দেশিকা, উপকরণ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে।
আইসিআরসি ও ডব্লিইএইচও উভয়ই লাশের মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করার জন্য লিবিয়ায় বডি ব্যাগ বিতরণ করছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সশস্ত্র সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মারা যাওয়া মানুষদের লাশ প্রায় কখনোই স্থানীয় জনগণের জন্য স্বাস্থ্যগত বিপদ ডেকে আনে না।
এর কারণ হলো ট্রমা, ডুবে বা আগুনে মারা যাওয়া মানুষেরা সাধারণত এমন রোগ সৃষ্টিকারী কোনো জীবাণু বহন করে না।
ব্যতিক্রম হলো- যখন ইবোলা বা মারবার্গ রোগ বা কলেরার মতো সংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যু ঘটে বা যখন এই সংক্রামক রোগগুলোর জন্য স্থানীয় অঞ্চলে বিপর্যয় ঘটে।
আরও পড়ুন: সাপের কামড়ের চিকিৎসা বিষয়ে ডব্লিউএইচও-এর প্রথম নির্দেশিকা প্রকাশ
তবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে লাশ পানির উৎসের কাছাকাছি বা পাশে থাকলে স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের কারণ হতে পারে।
কারণ লাশ থেকে বের হওয়া মল পানির উৎসকে দূষিত করতে পারে। যা ডায়রিয়া বা অন্যান্য রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
তাই পানীয় জলের উৎসের সংস্পর্শে লাশ ফেলে রাখা উচিত নয়।
আইসিআরসির ফরেনসিক ইউনিটের প্রধান পিয়েরে গাইয়োমার্চ বলেন, ‘লাশ মহামারি সৃষ্টি করবে এই ধারণার কোনো প্রমাণ নেই। আমরা এমন অনেক ঘটনা দেখতে পাই যেখানে মিডিয়া রিপোর্ট এবং এমনকি কিছু চিকিৎসা পেশাজীবীরাও এই সমস্যাটি সমাধানের ক্ষেত্রে ভুল করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ঘটনা থেকে বেঁচে থাকে, লাশের চেয়ে তাদের রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।’
ডব্লিউএইচও-এর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জৈব নিরাপত্তা ও জৈব নিরাপত্তা বিষয়ক মেডিকেল অফিসার ডা. কাজুনোবু কোজিমা বলেছেন, ‘আমরা ট্র্যাজেডির মুখে পড়া এলাকার কর্তৃপক্ষকে গণদাফন বা গণদাহ করার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করার জন্য অনুরোধ করছি। লাশের মর্যাদাপূর্ণ ব্যবস্থাপনা পরিবার ও সম্প্রদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রায়ই লড়াইয়ের দ্রুত সমাপ্তি আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।’
আইএফআরসি-এর জরুরি পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং মরক্কো আর্থকোয়েক রেসপন্সের জরুরি অপারেশনের প্রধান গওয়েন ইমার বলেন, ‘দুর্যোগ বা যুদ্ধে নিহতদের লাশ সমাহিত করার জন্য অপ্রয়োজনীয় তাড়াহুড়ো করলে পরিবারগুলোকে তাদের প্রিয়জনদের শনাক্ত করার এবং শোক করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। মর্যাদাপূর্ণ ব্যাবস্থাপনার জন্য লাশ শনাক্তকরণ এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়ম অনুসারে শোক ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য উপযুক্ত সময় প্রয়োজন।’
আইসিআরসি, আইএফআরসি ও ডব্লিউএইচও কর্তৃপক্ষ ও সম্প্রদায়কে নিম্নলিখিতগুলো মনে করিয়ে দিতে চায়:
লাশ দেখাটা দুঃখজনক হলেও, সম্প্রদায়ের নেতা বা কর্তৃপক্ষের তাড়াহুড়ো করে গণকবরে লাশ সমাহিত করা বা গণদাহ করা উচিত নয়। দাফন বা দাহ করার পদ্ধতি অবশ্যই সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক উদ্বেগের কথা মাথায় রাখতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সশস্ত্র সংঘর্ষে যারা মারা যায়, তাদের লাশ সাধারণত রোগের উৎস নয়।
আরও পড়ুন: প্রতি ৭ সেকেন্ডে একজন গর্ভবতী নারী বা নবজাতক মারা যায়: ডব্লিউএইচও
মৃত ব্যক্তি একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগে মারা না গেলে, জনসাধারণের জন্য ঝুঁকি খুব কম থাকে। তবে লাশের মল মিশ্রিত হয়ে দূষিত হওয়া পানি পান করলে ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য পানীয় জলের নিয়মিত জীবাণুমুক্তকরণ যথেষ্ট।
দ্রুত, অসম্মানজনক গণদাফন বা শ্মশান লাশ শনাক্তকরণ ও পরিবার শনাক্ত করা আরও কঠিন এবং কখনো কখনো অসম্ভব করে তোলে।
শুধুমাত্র লাশ তখনই মহামারির স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে, যখন নির্দিষ্ট কিছু সংক্রামক রোগে মৃত্যু ঘটে।
চুনের গুঁড়ায় দ্রুত পচন ধরে না। যেহেতু বিপর্যয় বা যুদ্ধে নিহতদের লাশে সাধারণত সংক্রামক ঝুঁকি নেই, তাই লাশগুলো জীবাণুমুক্ত করা প্রয়োজন হয় না।
তবে, নিহত ব্যক্তির লাশ স্পর্শ করার পর সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। অথবা দৃশ্যমান ময়লা না থাকলে অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
আইসিআরসি, আইএফআরসি ও ডব্লিউএইচও সকল পক্ষকে যুদ্ধ ও দুর্যোগে নিহতদের লাশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসরণ করার আহ্বান জানায়।