ভৌগলিক দিক থেকে নিম্নাঞ্চল ও মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে ফি বছর বন্যাপ্লাবিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। প্রতিবার দুর্যোগের সময় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এবং সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আগের থেকে বহুগুণে বেড়ে যায়। এ অবস্থায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাবার, ভিটে-বাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে বন্যাদুর্গত মানুষগুলো। এ অবস্থায় তাদের সহায়তায় প্রত্যেকেরই নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। তাই চলুন, বন্যাদুর্গতদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কার্যকর উপায়গুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে যে কার্যকর পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নেওয়া
একদম প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মোক্ষম ভূমিকা রাখতে পারে স্বেচ্ছাসেবকরা। এই বিপর্যস্ত সময়ে দুর্যোগের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিভিন্ন সেবামূলক কাজের চাপ থাকে অনেক বেশি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- যাতায়াতের অযোগ্য জায়গা থেকে মানুষকে উদ্ধার কাজ, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং চিকিৎসা সেবা প্রদান। এর সঙ্গে আরও রয়েছে খাদ্য, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরবরাহগুলো সুসংগঠিত এবং বিতরণ করা। এরকম চাপের মধ্যে আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয় স্বেচ্ছাসেবকরা, যাদের মাধ্যমে সংস্থাগুলো অসহায় মানুষদের কাছে আরও বেশি সাহায্য পৌঁছাতে পারে।
এছাড়াও স্বেচ্ছাসেবীরা অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের কাজেও সহায়তা করতে পারে। এছাড়াও বন্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের মানসিক সমর্থন এবং মনোবল বাড়াতেও স্বেচ্ছাসেবীদের যথেষ্ট করণীয় রয়েছে।
আরও পড়ুন: বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত রোগ থেকে সতর্ক থাকার উপায়
জরুরি সামগ্রী সরবরাহ
বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে অপুষ্টি ও ডিহাইড্রেশন স্বাভাবিক বিষয়। এগুলো প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে অপচনশীল খাদ্য সামগ্রী ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ।
কাটা-ছেঁড়া বা জখমের চিকিৎসা এবং রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য ফার্স্ট এইড কিট, ওষুধ এবং স্বাস্থ্যবিধি পণ্যগুলো অতীব জরুরি। এই সরবরাহগুলো অবশ্যই স্কুল-কলেজ বা স্থানীয় বহুতল ভবনগুলোর মতো অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানো উচিত। মূলত তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত এই স্থাপনাগুলোতে আশ্রিতদের প্রত্যেকের চাহিদা পূরণের জন্য সরবরাহগুলো সুসংগঠিত বিতরণ আবশ্যক।
স্থানীয় সংস্থা বা এলাকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এই কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা উচিত। এতে করে যাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রয়োজন সর্বপ্রথম তাদের কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা বাড়বে।
আরও পড়ুন: বন্যার সময় খাবার পানি পরিশোধিত করার উপায়
তাৎক্ষণিক উদ্ধার অভিযান
বন্যায় আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারে যেহেতু পানি পেরিয়েই যেতে হয়, তাই এখানে সাধারণত নৌকাই বেশি ব্যবহৃত হয়। এই নৌকাগুলোর মাধ্যমে উদ্ধারকারীরা জলমগ্ন রাস্তা পেরিয়ে ভাসমান লোকদের কাছে পৌঁছাতে পারে। তবে দ্রুত পৌঁছাতে এবং কম সময়ে বেশি সংখ্যক এলাকার লোকদের উদ্ধার কাজে স্পিডবোট ব্যবহার করা উচিত। যাতায়াতের একদম অযোগ্য স্থানগুলোর ক্ষেত্রে সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে হেলিকপ্টার। এর মাধ্যমে বিপজ্জনক জায়গা থেকে অনায়াসেই অসহায় মানুষদের তুলে নেওয়া যেতে পারে।
প্রাণিসম্পদ উদ্ধার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা
গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারেরই জীবন-জীবিকার প্রধান উপায় হচ্ছে গবাদিপশু। বন্যার সময়ে এই প্রাণীসম্পদের ক্ষতি পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা ও আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের রক্ষার্থে অর্থায়ন কিংবা প্রাণীগুলোর উদ্ধার কাজে সরাসরি যোগদান করা উচিত।
এরই ধারাবাহিকতায় পশুর খাদ্য, পশুচিকিৎসা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিষেবার প্রসঙ্গও আছে। কেননা এর ওপর বন্যা পরবর্তীতে তাদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নির্ভর করছে। এমনকি অল্প কিছু আর্থিক অনুদানও পরিবারগুলোর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সাহায্যে আসতে পারে।
আরও পড়ুন: বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বেই যেসব খাবার সংরক্ষণ করা জরুরি
প্রসিদ্ধ এনজিওগুলোতে অর্থ দান
দেশব্যাপী বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন দুর্যোগে ব্যাপক পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সেবার মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করে আসছে। এমনকি তারা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও স্যানিটেশন অবকাঠামোও স্থাপন করে থাকে।
এই কার্যক্রমগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ ছাড়া শুধুমাত্র অর্থদানও করা যেতে পারে। এই অর্থ সংস্থাগুলোর জরুরি দ্রব্য, ওষুধ ক্রয় ও পরিবহন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন এবং জরুরি সহায়তা দানকারী দল গঠনে সাহায্য করতে পারেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত পৌঁছানো, তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় ধরনের প্রয়োজন মেটানো নিশ্চিত করতে এই সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষতিকারক পোকামাকড় এবং সাপ নির্মূল অভিযান
প্লাবনকালে বেড়ে যায় মশা ও অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের উপদ্রব। আর এর রেশ ধরে পরবর্তীতে বাড়তে থাকে ডেঙ্গু জ্বর এবং ম্যালেরিয়ার মতো রোগের ঝুঁকি। এমতাবস্থায় মশার ফাঁদ, মশা তাড়ানোর উপকরণ এবং রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে দরকারি শিক্ষা উপকরণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
আরও পড়ুন: স্পঞ্জ সিটি: ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বন্যা-জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান
এছাড়াও, বিষধর সাপের উপস্থিতি বন্যাগ্রস্ত অসহায় মানুষদের আরও একটি হুমকি। বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত ও ভাসমান জনগোষ্ঠীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকে। তাই এমন একটি নিবেদিত দল থাকা প্রয়োজন যাদের উদ্দেশ্যই হবে সাপ খুঁজে বের করে তা নিধন করা। একই সঙ্গে এরা জনসাধারণকে সাপবিরোধী বাধা স্থাপন এবং সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসাও শেখাবে।
গণসচেতনতা সৃষ্টি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও এলাকাভিত্তিক মাইকিংয়ের মতো অফলাইন পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে বন্যাকালীন জরুরী প্রয়োজনগুলো প্রচার করা যায়। এখানে বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির অভাব, চিকিৎসা সরবরাহ, বা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র-এর বিষয়গুলোর উপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। এর ফলে বিভিন্ন সংস্থানগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকেও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের অবস্থা সৃষ্টি হবে।
সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানগুলো অনুদান এবং স্বেচ্ছাসেবী কাজকেও উৎসাহিত করতে পারে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী সংহতি বোধের অনুকূলে সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। এই গণসচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে নিকট ভবিষ্যতে দুর্যোগের বিষয়ে এমনকি উপযোগী নীতি নির্ধারণের দিকে ধাবিত হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।
আরো পড়ুন: প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পশু-পাখির সুরক্ষা: বন্যা, খরা ও শৈত্য প্রবাহে করণীয়