আসছে ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক সীমানা পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস এর উদ্যোগে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী (রোহিঙ্গা) সমস্যা নিয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের জুন ২০২২ এর হিসাবে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম এই শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষগুলো দৈনন্দিন ও দীর্ঘমেয়াদি সকল প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সাহায্যের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
এই মানবিক সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকার শুরুতেই বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে তাদের নীতিমালা অনুযায়ী সরকারের সহায়ক হয়ে এই সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানায়। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি)’র সহায়তায় এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে কক্সবাজারে পপুলেশন মুভমেন্ট অপারেশন (পিএমও) নামে একটি আন্তর্জাতিক অপারেশন যাত্রা শুরু করে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব, কাজী শফিকুল আজম বলেন:‘সংকটটি ইতোমধ্যেই একটি জটিল ও দীর্ঘায়িত বাস্তুচ্যুতি সংকটে পরিণত হয়েছে। এজন্য, শরণার্থী ক্যাম্প ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে বর্তমানে চলমান কার্যক্রম সমন্বয় করে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিৎ। আমরা এই সঙ্কট নিরসনের জন্য প্রতিশ্রুতি ও সহায়তার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
আরও পড়ুন:রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সহায়তা চায় ইউএনএইচসিআর
ক্যাম্পের মোট জনগণের ৫১ শতাংশই শিশু এবং প্রায় ৫২ শতাংশ নারী ও কিশোরী। প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে একটির সদস্যরা সহজেই মানব পাচার, বাল্যবিয়ে, যৌন শোষণ ও নিপীড়ন ইত্যাদির শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ক্যাম্পে বাস্তবায়িত বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন-স্বল্পমেয়াদী আশ্রয়কেন্দ্র, টেকসই আবাসন, সৌরচালিত পানি সঞ্চালন নেটওয়ার্ক, দুর্যোগ নিরসনসহ গৃহীত স্থায়িত্বশীল উদ্যোগ অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।
আইএফআরসি-র এশিয়া প্যাসিফিক আঞ্চলিক পরিচালক, আলেকজান্ডার ম্যাথিউ বলেন, ‘ক্যাম্পে বাইরে থেকে যা দৃশ্যমান, তা গত পাঁচ বছরের অনেক উদ্যোগের ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমরা বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থাকে তাদের এই অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু যা দৃশ্যমান নয় অথচ ক্যাম্পে বসবাসরত মানুষের জীবনে ঘটে চলেছে, তা হচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তাদের কোনো কাজ বা চলাফেরার স্বাধীনতা নেই, বরং কম হলেও অনিবার্যভাবে আছে বিষন্নতা, পাচার, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতাসহ অন্যান্য সহিংসতার শিকার হবার ঝুঁকি। যেহেতু কোন স্থায়ী সমাধান এখনও নিশ্চিত নয়, মানবিক সহায়তা হিসেবে জীবন রক্ষাকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বিনোদন এবং সুরক্ষা ব্যবস্থার উপরও জোর দেওয়া দরকার।’
পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে কক্সবাজারের ভৌগলিক অবস্থানের জন্য, যা অতিমাত্রায় ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। এই এলাকা হরহামেশাই জলোচ্ছ্বাস, বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়সহ ভারি বর্ষণের শিকার হয় যার ফলে ভূমিধ্বস, জলাবদ্ধতা, ঘরবাড়ির ক্ষতি, ঘনঘন আগুন, মহামারি যেমন কলেরা, ডেঙ্গু, এবং ডিপথেরিয়াসহ বিভিন্ন দুর্যোগ এই এলাকার নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠেছে। তার উপর ক্যাম্পের ঘনবসতির কারণে কলেরা ও কোভিড মাঝে মাঝেই অতিমারির আকার ধারণ করে।
আইএফআরসি, বাংলাদেশ ডেলিগেশনের প্রধান সঞ্জিব কাফলে বলেন, ‘এই সংকট আইএফআরসি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং দুরূহ মানবিক সহায়তা কার্যক্রম। গত পাঁচ বছর ধরে ক্যাম্পে সুরক্ষাসহ যাবতীয় মানবিক সহায়তা প্রদানে, আইএফআরসি ও তার সহযোগী ন্যাশনাল সোসাইটিগুলো বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টকে সহায়তা করে আসছে। কোভিড-১৯ এর অভিজ্ঞতার আলোকে, আইএফআরসি এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির উপর কাজ করছে। তাই কক্সবাজারের বাস্তুচ্যুত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে আইএফআরসি'র বর্তমান কৌশল হচ্ছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত কম্যুনিটিতে সমন্বিত কম্যুনিটি সহনশীলতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরন এবং কার্যকর দুর্যোগ সাড়াদান ইত্যাদিতে মনোযোগ বৃদ্ধি।’
আইএফআরসি এবং অন্যান্য সহযোগী ন্যাশনাল সোসাইটির যৌথ সহযোগিতায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এই জরুরি মানবিক প্রয়োজন মেটাতে ও তা বৃদ্ধিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আশ্রয়, স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তা, ওয়াশ, জীবিকায়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষার মানবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে। সেই সাথে সুরক্ষা, জেন্ডার ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্তর্ভুক্তিকরণ, জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করা এবং জবাবদিহিতা ইত্যাদিকে মূলধারায় নিয়ে আসার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সহায়তা চায় ইউএনএইচসিআর