গ্রন্থাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেননা শিক্ষক ও ছাত্রদের সমস্ত একাডেমিক প্রয়োজন মেটায় এ গ্রন্থাগার৷ কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লাইব্রেরি ‘অবশ্যই’ যা হওয়া উচিত তা হয়ে উঠে নি। দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেরা বলে বিবেচিত হওয়া ঢাবি প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে গ্রন্থাগার আধুনিকায়নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে নি।

অনেকগুলো সমস্যা অমিমাংসিত রেখে চলতি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার ১০০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করেছে। এরূপ অনেকগুলো অমীমাংসিত সমস্যার একটি হলো গ্রন্থাগার সমস্যা। 

লাইব্রেরিতে পড়াশুনার জন্য জায়গা পেতে ছাত্রদের প্রতিদিনই যেনো এক যুদ্ধে নামতে হয়। শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে লাইব্রেরি সম্প্রসারণের জন্য গত ১১ বছরে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন: করোনায় ঢাবি অধ্যাপকের মৃত্যু

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি বেশ আশ্চর্যজনক যে ১৫ বছরের ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গ্রন্থাগারের সুবিধা সম্প্রসারণের আলাদা কোন পরিকল্পনা নেই। মাস্টার প্ল্যানে স্পষ্টতই গ্রন্থাগার সুবিধা সম্প্রসারণের একটি সুযোগ রয়েছে। তবে এর বাস্তবায়ন দেখার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রায় ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে।

ইউএনবির সঙ্গে আলাপকালে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সে অনুযায়ী গ্রন্থাগারগুলোর সম্প্রসারণ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে প্রবেশে অনীহা তৈরি হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বহিরাগত ও অনিয়মিত শিক্ষার্থীরা সাধারণত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা এবং অন্যান্য সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাইব্রেরির টেবিল দখল করে রাখছে। যা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পড়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে।

এছাড়া অপর্যাপ্ত বই, বই প্রাপ্তিতে সুযোগের অভাব এবং শৌচাগারের সমস্যা অনেকের কাছে লাইব্রেরিকে অপ্রীতিকর করে তুলেছে।

ঢাবির ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য তিনটি লাইব্রেরিতে মাত্র তিন হাজার ৪০০ আসন রয়েছে । এর  মধ্যে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে দুই হাজার ৩০০, বিজ্ঞান অনুষদ গ্রন্থাগারে ৪০০ এবং ই-লাইব্রেরিতে ২০০-২৫০টি সিট রয়েছে। যার ফলে একটি সিটের জন্য ১১ জন শিক্ষার্থীর লড়াই করতে হচ্ছে।

ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ডক্টর মো. নাসিরউদ্দিন মুন্সী জানান, ২০০৯ সালের শুরুর দিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় সম্প্রসারণ বিভাগে ৫০০ আসন বাড়ানো হলেও গত ১১ বছরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বসার ব্যবস্থায় কোন সম্প্রসারণ হয়নি।

তিনি বলেন, অপ্রতুল লাইব্রেরি সুবিধা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সমস্যা। আমরা সমস্যাগুলোর অবসান ঘটাতে মাস্টার প্ল্যানে একটি বহুতল লাইব্রেরি অন্তর্ভুক্ত করেছি। যদিও এটি বাস্তবায়িত হতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগবে।

আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রীকে নির্যাতন করে হত্যা: স্বামী গ্রেপ্তার

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, লাইব্রেরি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য অংশ। এটি শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, শিক্ষকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একাডেমিক গতিশীলতার স্বার্থে আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রন্থাগারকে নতুন করে সাজাতে হবে।

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তামান্না তারিন বলেন, অপ্রতুল লাইব্রেরি সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় সমস্যা। দুই শিক্ষার্থীকে একটি টেবিল শেয়ার করতে হয় যা তাদের পড়াশোনায় মনোযোগকে বাধাগ্রস্ত করে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিটি তলায় মাত্র দুটি শৌচাগার রয়েছে ।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে একটি ভালো পরিবেশ এবং যথাযথ সুবিধা নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। সেখানে আমাদের কাছে বইয়ের সহজ অ্যাক্সেস নেই এবং বইয়ের সংখ্যাও অপর্যাপ্ত।

আরও পড়ুন: আতশবাজির ঝলকানিতে শেষ হলো ঢাবির শতবর্ষ উদযাপন

আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সাইফুর রহমান বলেন, লাইব্রেরিতে বসার জন্য আমাদের খুব ভোরে আসতে হয়। আমি যদি দুপুরে সেখানে যাই, তাহলে আমি পড়তে পারব না। কারণ লাইব্রেরির সিট এর আগেই দখল হয়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, শব্দ দূষণ ও অপর্যাপ্ত আলোর কারণে গ্রন্থাগারের অভ্যন্তরের পরিবেশ আরও বেশি অনুপযোগী ও উদ্বেগজনক।

মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফারিয়া আলম বলেন, ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বিভিন্ন খাবারের স্টল স্থাপন এবং এর করিডোরে বিপুল সংখ্যক সাইকেল পার্কিংয়ের কারণে এটি শিক্ষা উপযোগী পরিবেশ হারিয়েছে।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র জোবায়ের আহমেদ বলেন, যখন আমরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যাই, সেখানে আমরা খুব একটা খালি আসন পাই না। এছাড়া কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা নেই।

আরও পড়ুন: ঢাবি কর্তৃপক্ষকে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর

অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ (ওএসএল) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবু তৈয়ব বলেন, আমি গ্রন্থাগারে পড়ার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, সরঞ্জাম এবং পরিবেশ দেখিনি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি আমাদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই অবহেলা করা হয় তাহলে কীভাবে আমরা আমাদের প্রতিভার বিকাশ করতে পারি?

উপাচার্যের বক্তব্য

এই হতাশাজনক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, সিট স্বল্পতা থাকলেও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরি, হল লাইব্রেরি ও রিডিং রুমে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, লাইব্রেরি যত ভালো হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তত ভালো। যে মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে তা আমাদের হাতে, এটি এই সমস্যার সমাধান করবে।

তবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত বছর লাগবে সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন উপাচার্য।