সমুদ্র পর্যটন খাতে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রয়োজন শুধুমাত্র একটি সমন্বিত উদ্যোগ। যার ফলে এ খাত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করবে বলে ইউএনবিকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কাওসার আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে একসাথে যুক্ত করতে পারলে আমরা সমুদ্র পর্যটন খাত থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করতে পারব।’
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘উন্নত রাষ্ট্রের’ মর্যাদায় উন্নীত করতে সমুদ্রের পর্যটন খাতকে কাজে লাগানোর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে, সরকারের শুধু রাজস্ব আয়ই নয়, সেই সাথে দেশের মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় পর্যটকদের জন্য পরিবেশগত শুল্ক নির্ধারণের মতো যথাযথ পদক্ষেপও নিতে হবে বলে মনে করেন ড. মো. কাওসার।
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, ‘আমরা সরকারেক সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাওয়ার জন্য প্রত্যেক পর্যটকদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা এবং প্রতি রাত্রিযাপনে ন্যূনতম এক হাজার টাকা করে পরিবেশ কর আদায় করার প্রস্তাব দিচ্ছি। আমরা আশা করছি পর্যটকরা স্বেচ্ছায় এ টাকা দেবেন।’
পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য সেন্ট মার্টিনে স্কুবা ডাইভিং চালুর প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
ড. মো. কাওসার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশি পর্যটকদের প্রধান গন্তব্যস্থল হতে পারে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাথে সমুদ্রপথে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও ভারতকে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এটিকে সফল করার জন্য সরকারি পর্যায়ে চুক্তি করতে হবে।
তবে আরেক বিশেষজ্ঞ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘দেশের পর্যটন খাতের উন্নয়ন দরকার, তবে পরিবেশের ক্ষতি করে নয়। আমাদের প্রথমে পরিবেশকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পর্যটনের নামে আমরা আমাদের সম্পদ ধ্বংস করতে পারি না। আমাদের সমুদ্রের প্রবালগুলোকেও রক্ষা করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে সমুদ্রের মধ্যে যাত্রীবাহী জাহাজ চালানোর জন্য সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। তাহলেই দেশীয় ও আঞ্চলিক পর্যটকরা এসব পর্যটনের স্থানগুলোতে ভ্রমণে আসবে। এভাবেই পর্যটন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবকাশ পর্যটনের মালিক শিবলুল আজম কোরেশি বলেন, ‘পর্যটকদের কাছে এ দ্বীপের এখন আর তেমন আকর্ষণ নেই। আগে ভ্রমণের মৌসুমে বছরের ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এ দ্বীপে গড়ে ২০০০ পর্যটক প্রতিদিন আসতেন। বৈরী আবহাওয়া ও কোভিড মহামারির কারণে এখন অনেক কম দেশীয় পর্যটক এ দ্বীপে ঘুরতে আসেন।’
দেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সহ-সভাপতি আরও বলেন, সমুদ্র পর্যটন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। টেকনাফের সাবরাংয়ে সরকার পর্যটন অঞ্চল গড়ে তুলছে। এখান থেকে পর্যটকরা বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ ও বঙ্গোপসাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে সরকারের সুনীল অর্থনীতির (ব্লু ইকোনমি) প্রতি নজর দেয়া উচিত। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জেতায় বঙ্গোপসাগরে এখন আর কোনো সমস্যা নেই। সুনীল অর্থনীতির হিসেবে পরিচিত সমুদ্র অর্থনীতি মৎস্য, খনিজ সম্পদ, শিপিং ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সুযোগ এনে দেবে।’
শিবলুল জানান, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এখন ১৫০ অবকাশ ও রেস্টুরেন্ট আছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারকে এখানে ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট’ স্থাপন করতে হবে। দ্বীপটিকে আলোকিত করতে এখানে সৌরশক্তির যোগান বাড়ানো উচিত।
বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে মাছ ধরার ও সম্পদ অনুসন্ধানের অধিকার আছে বাংলাদেশের। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বার্ষিক প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান রয়েছে সমুদ্র খাতের। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির মোট মূল্য সংযোজনের (জিভিএ) পরিমাণ ছিল ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন ও ভ্রমণ খাতের অবদান ছিল ৮৪০.২ বিলিয়ন টাকা। যা জিডিপির প্রায় ৪.৩ শতাংশ।
অন্যদিকে, ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্য অনুসারে, এ খাত থেকে অর্জিত প্রবৃদ্ধির পরিমাণ প্রতিবছর ৭.১ শতাংশ করে বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের জিডিপিতে এর মোট অবদান গিয়ে দাঁড়াবে এক হাজার ৭৮৩ বিলিয়ন টাকা বা ৪.৭ শতাংশে।