৭ জানুয়ারির আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি এই তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।’ আসন্ন নির্বাচন একতরফা হলে দেশের সংকট আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ চলতি সপ্তাহে ঢাকায় ইউএনবির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামত জানিয়েছেন।
এসময় ড. দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একদলীয় নির্বাচন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও বাড়াবে। কারণ বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ একটি সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়, যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যও খুব প্রয়োজন।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দল তৈরি করে তাদের ইচ্ছামতো নিবন্ধন দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এখানে বিভিন্ন স্বার্থ রয়েছে বলে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। আগামী নির্বাচন আগের গত নির্বাচনের মতো হবে, না কি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক হবে তারা তা পর্যবেক্ষণ করছেন।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ দীর্ঘদিন ধরে মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা সহ্য করে আসছে, অথচ মহামারির পরে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও অনেক দেশ এক্ষেত্রে উন্নতি করেছে।
তিনি বলেন, এখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি, যা আগে দেখা যায়নি।
তার মতে, টাকার ক্রমাগত দরপতনের কারণে আমদানি মূল্যস্ফীতির মুখে পড়তে হচ্ছে জনগণকে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কোনো দৃশ্যমান লক্ষণ নেই।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে যাওয়ায় রাজস্ব উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, রাজস্ব বোর্ডের অদক্ষতার কারণে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সবসময়ই অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করে: আহসান মনসুর
ড. দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচনের বছরের মধ্যেও সরকার স্থানীয় সরকার পর্যায়ে প্রতিশ্রুত উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করতে পারে না।
তিনি বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত এই স্থবিরতা যাবে না। সব খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য এটি প্রয়োজনীয়।
তিনি আরও বলেন, আমদানির ব্যাপক পতন অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি সৃষ্টি করেছে এবং কয়েকটি সিন্ডিকেট এটিকে দাম বাড়ানোর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে।
ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক আয় বাড়ানো সত্ত্বেও রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে, দুর্নীতি ও অর্থপাচার কমছে না; জবাবদিহিতার অভাবে এগুলো ঘটছে।
তিনি বলেন, সরকার টপ টু বটম কোথাও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে না, কারণ রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা না থাকায় তারা আমলা ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার উপর নির্ভরশীল।
তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও কিছু প্রভাবশালী দেশ হস্তক্ষেপ করছে, যা আগে কখনো হয়নি। এগুলো সবই এখানে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের ফলাফল এবং তারা (বিদেশিরা) রাজনৈতিক মতবিরোধ ও সরকারের নৈতিক বৈধতার অভাবের সুযোগ নিচ্ছে।
গত নির্বাচনের বৈধতা প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, সংবিধানের বিবেচনায় ওই নির্বাচনগুলো বৈধ হলেও, রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতার অভাব ছিল।
তিনি বলেন, একটি দেশ শক্তিশালী হয় যখন তার স্বাধীন রাষ্ট্রীয় অঙ্গগুলো শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা উভয় পক্ষ পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করছে।
শ্রম অধিকারের বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, পশ্চিমা বিশ্ব কাজের পরিবেশ, অযথা হয়রানি এবং শ্রম অধিকার কর্মীদের জোরপূর্বক গুম করা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। পশ্চিমা জনগণ; যারা বাংলাদেশের পোশাক এবং অন্যান্য পণ্যের ক্রেতা, তারা এই বিষয়গুলো নিয়ে খুবই সচেতন ও উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক খাতেই সংস্কার করতে হবে। যেমন- বিপুল খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করা, অর্থপাচার কমানো, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করা।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে, বাংলাদেশি পণ্য, জনশক্তি ও রেমিটেন্সের রপ্তানি গন্তব্যের কথা মাথায় রেখে দেশকে বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: নির্বাচনের আগে অবরোধ ও হরতালের কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে: ড. আতিউর
নির্বাচনের আগে অফশোর হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা স্থগিত