কালিয়া উপজেলার আটলিয়া গ্রামের ২৯ বছরের ঝুমা বেগম। সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে আদর তো দূরে থাক, কোলে নেবার সামর্থও নেই তার। জরায়ু কেটে যাওয়ায় নিজের ভবিষৎ দাম্পত্য জীবনের দুশ্চিন্তায় আর তৃতীয় দফা অপারেশন করতে হবে এই শঙ্কায় দিন কাটছে তার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঝুমা বেগম বলেন, ‘আমি কোনোদিন মা হতে পারব না, কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারব কিনা তাও জানি না। আমাকে আগের অবস্থায় কী ফিরিয়ে দিতে পারবেন ডাক্তার আকরাম? আমি ডাক্তারকে ডাকলাম কিন্তু উনি ফ্লাইটের তাড়া থাকায় আমাকে একটিবারও দেখলেন না।’
আরও পড়ুন: ইম্প্যাক্ট জীবন তরী ভাসমান হাসপাতাল এখন ঝালকাঠিতে
নড়াইল শহরের ভওয়াখালী গ্রামের খন্দকার মাহফুজ নূর। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ঝুমাকে গত বছর ১৪ ডিসেম্বর শহরের ইমন ক্লিনিকে ভর্তি করেন। অপারেশনে বাচ্চা প্রসবের পর থেকে রোগীর যন্ত্রণা শুরু হয়, এরপর রক্তপাত শুরু হয়। এই অবস্থায় চিকিৎসা না দিয়েই জোর করে ক্লিনিক থেকে তাকে বের করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর আল্ট্রাসনো করে পেটের ভেতরে জমাট বাধা রক্ত দেখা যায়। স্ত্রীকে বাঁচাতে খুলনার একটি ক্লিনিকে নিয়ে গেলে জানতে পারেন ঝুমার পেটের ভেতরে পচন ধরায় জরায়ু, প্রস্রাবের নালী কেটে ফেলতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে ২য় দফা অপারেশন করা হয় ঝুমার। কয়েক দফায় ৪ লাখ টাকা খরচ করলেও ঝুমা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন। প্রতিকার চেয়ে ক্লিনিকের দুই মালিক আর চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ২৫ জানুয়ারি আদালতে মামলা করেছেন।
একই মাসে ইমন ক্লিনিকে ভওয়াখালির মৌসুমী খানমের সিজার অপারেশনের পাঁচদিন পর সেলাই কাটতে গিয়ে দেখা গেল কোনো সেলাই লাগেনি। সন্তান প্রসবের পর তার তলপেটে যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। ক্লিনিকে অভিযোগ জানালে ক্লিনিকের লোকেরা এসে কয়েক ডোজ ব্যথার ইনজেকশন দিয়ে পরে আবার তলপেট কেটে সেলাই করেন।
আরও পড়ুন: কুষ্টিয়ায় রেলওয়ের হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রভাবশালীদের মার্কেট নির্মাণ!
মৌসুমির স্বামী তিতাসের অভিযোগ, ইমন ক্লিনিকসহ অনেক ক্লিনিকে কমদামী সুতা ব্যবহার হয়, কোথাও ডাক্তার নেই এমনকি নার্সও নেই, সম্পূর্ণ খামখেয়ালীতে চিকিৎসা চলছে।
ইমন ক্লিনিকে মা হতে এসে বেশ করুণ অবস্থা হয়েছে দিঘলিয়ার সুজয় ঘোষের স্ত্রী সুপ্রিতী ঘোষের। অপারেশন হবার পরে তার শরীরে ইনজেকশন পুশ করে একজন আয়া, যে ইনজেকশন ধীরে ধীরে অর্ধেক অ্যাম্পুল শরীরের পুশ করার কথা আয়া ওই ইনজেকশন পুরোটাই একবারে শরীরে পুশ করেন। এতে সুপ্রিতী ঘোষের মরার উপক্রম হলে জরুরিভাবে তাকে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হলেও এখনও আশঙ্কা কাটেনি।
সুজয় ঘোষের অভিযোগ, ইমন ক্লিনিকে কোনো ডিপ্লোমা নার্স নেই, আয়ারাই নার্স। ক্লিনিক মালিকের স্ত্রী নার্স না হয়েও অপারেশন থিয়েটারে থাকেন। পারিবারিক সব কাজই চলে অপারেশন থিয়েটারে। নিজেদের ডিসপেন্সারি থেকে ওষুধ বিক্রি আর রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করলেও এখানে সেবার বদলে বাজে চিকিৎসা পাওয়া যায়।
৩ বছর আগে একই রকমভাবে ইমন ক্লিনিকে মা হতে এসে আজও যন্ত্রণায় ভুগছেন চাচুড়ি গ্রামের ৩০ বছরের সুমনা বেগম।
আর পড়ুন: নাটোরে তিন ক্লিনিককে ২.৫৫ লাখ টাকা জরিমানা
সরেজমিন ইউএনবির এই প্রতিনিধি ইমন ক্লিনিকে গেলে সেখানে কোনো প্রশিক্ষত নার্স পাননি। কয়েকজন আয়াকে নার্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্লিনিক মালিকের স্ত্রী শিল্পি বেগম দ্রুত প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে ছুটে আসেন। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে পর্দা দিয়ে আঁড়াল করে অন্যান্য আসবাবপত্র রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটি রোগীর প্রেসক্রিপশনে ২০/২২টি করে ওষুধের নাম লেখা আছে। কয়েক মাস হলো বেসরকারি একটি কলেজ থেকে সদ্য পাস করা একজন আবাসিক চিকিৎসক থাকলেও তার রুমের সামনে কোনো নেমপ্লেট দেখা গেল না। মালিক সরোয়ার হোসেন এরপরই নিচ থেকে দোতলায় আসেন। কিছুটা হম্বিতম্বি করার চেষ্টা করলেও পরে থেমে যান। কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করেন ক্লিনিকে আসার জন্য।
আবাসিক চিকিৎসক ডা. সপ্নীল আকাশ চিকিৎসার নানা সমস্যা বিষয়ে নিজেদের দায় স্বীকার করে বলেন, ‘সব সময়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটে না, এটা অনেকটাই অনাকাঙ্ক্ষিত।’
ক্লিনিক মালিক সরোয়ার হোসেন একটি মাত্র ভুল চিকিৎসার কথা স্বীকার করলেও বাকিগুলো রোগীদের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, ‘রোগীরা অসচেতনভাবে চলাফেরার কারণে ভোগে। আবার প্রেসার বেড়েও অসুস্থ হতে পারে। এসবই নির্ভর করে উপরওয়ালার উপর।’
ডিভাইন ক্লিনিক মালিক ডা. শামীম আক্তার বলেন, ‘একটি ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক ও নার্স আব্যশক থাকতে হবে। কোন কোন ক্লিনিকের চিকিৎসার গাফিলতির জন্য আমাদের সব ক্লিনিকের যেমন দুর্নাম হয় তেমনি অন্তঃসত্ত্বা নারীরা দীর্ঘ রোগে ভোগেন।’
বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এস এম সাজ্জাদ রহমান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মাসিক মিটিং করি, ক্লিনিকগুলোর কোনো দুর্বলতা থাকলে সেগুলো সংশোধনের জন্য বলা হয়।’
আরও পড়ুন: কুমিল্লায় ক্লিনিক ও ফার্মেসির জরিমানা
শুধু ইমন ক্লিনিকই নয়, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে মর্ডান সার্জিক্যাল ক্লিনিক, লোহাগড়ার মা সার্জিক্যাল ক্লিনিক, আল ইসলামিয়া ক্লিনিক, মোর্শেদা ক্লিনিক, মিজানুর নার্সিং হোম তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ক্লিনিকের নিয়ম না মেনেই চলছে কালিয়ার, কালিয়া সার্জিক্যাল ক্লিনিক। এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক ক্লিনিক আর বড়দিয়ার হাজী খান রওশন আলী হাসপাতাল লাইসেন্স ছাড়াই গত ৩ বছর ধরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলায় বর্তমানে ৬০টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেশিরভাগই লাইসেন্স হালনাগাদ নেই। চারটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রক্রিয়াধীন, ৯টি লাইসেন্সবিহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বহাল তবিয়তে চালু রয়েছে। এই অবস্থায় নতুন আরও চারটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে।
আরও পড়ুন: চৌগাছায় ১০ ক্লিনিকের ৩টি লাইসেন্সবিহীন, নবায়ন নেই ৭টির
নড়াইলের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহীতা ফোরামের আহ্বায়ক কাজী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে নড়াইলে অবৈধ ক্লিনিক ব্যবসা চলছে। সি এস সাহেবরা এসেই দুই মাসের মধ্যে ঠিক করে ফেলবেন বলেন কিন্তু কোন কারণে কিছুই করেন না ঠিক বোঝা যায় না।’
গতানুগতিক ধারায় নড়াইলের সিভিল সার্জন ডা. নাসিমা আকতার বলেন, ‘লাইসেন্স না থাকলে সেই ক্লিনিকগুলো আমরা বন্ধ করে দেব।’
আর মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কয়েকটি মামলা এসেছে এগুলো আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেব।’