বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য হিসেবে প্রায় শতাধিক পরিবার ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সন্তানের মতোই বুকে আগলে রেখেছে ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্পকে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ঝাড়ু তৈরি হওয়ায় এই এলাকাটি ঝাড়ু পট্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিন্তু ঝাড়ু তৈরিতে এই এলাকার শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখলেও আজও এই শিল্পটি বিসিকের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে সরকারি বা বেসরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ঝাড়ু শিল্পের এই কারিগররা। এমনকি মহামারি করোনাভাইরাসের সময় অন্য সব পেশার মানুষ প্রণোদনা পেলেও এই শিল্পের কারিগরদের ভাগ্যে কোনো প্রণোদনা জোটেনি।
আরও পড়ুন: অনিয়ম-দুর্নীতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্প
সরেজমিনে এলংগী ঝাড়ু পট্টি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় শত বছর আগে ইসমাইল নামের একজন কারিগর এই অঞ্চলে প্রথম ঝাড়ু তৈরির কাজ শুরু করেন। এরপর ইসমাইলের ছেলে সেলিম ও তার ছেলে কালামের হাত বদলিয়ে বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এই শিল্পটি। যান্ত্রিক যুগে ঝাড়ুর বিকল্প যন্ত্র তৈরি হলেও এই এলাকার প্রায় শতাধিক পরিবার এখনো পরম যত্মে আগলে রেখেছেন এই শিল্পটিকে।
তবে দিনের পর দিন নানা কারণে বংশ পরম্পরায় এই পেশা ধরে রাখা তাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝাড়ু তৈরির প্রধান কাঁচামাল ছনখড় আগে যেখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যেত এখন সেই ছনখড় দূর-দূরান্ত থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। তাও আবার সারা বছর ছনখড় পাওয়া যায় না।
বছরের চৈত্র, বৈশাখ মাসসহ মাত্র কয়েকমাস পর্যাপ্ত ছনখড় পাওয়া যায়। কিন্তু সারা বছর কাজ চলমান রাখতে হলে কাঁচামাল কিনে মজুদ রাখা ছাড়া বিকল্প আর কোনো উপায় থাকে না। এখানকার কারিগররা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় পর্যাপ্ত কাঁচামাল কিনে মজুদ করতে পারে না। অনেকে বেসরকারি বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কাঁচামাল সংরক্ষণ করে। কিন্তু সেখানে সুদের হার বেশি হওয়ায় গরীব কারিগরদের পক্ষে প্রতিবছর ঋণ নিয়ে কাঁচামাল মজুদ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে অবৈধ বালু উত্তোলন, হুমকিতে নদীর তীরবর্তী এলাকা
জানা যায়, প্রতিটি ঝাড়ু তৈরিতে ৩ থেকে ৫ জন লোকের প্রয়োজন হয়। কেউ ছনখড় ঝাড়া দেয়, কেউ গুছি বাঁধে কেউবা মুড়াই আবার আরেকজন দড়ি দিয়ে বেঁধে পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ু তৈরি করে। প্রতিটি ঝাড়ু তৈরিতে খরচ হয় ৩ থেকে ৫ টাকা। বাজারে বিক্রি হয় ৫ থেকে ৭ টাকায়। দলবদ্ধভাবে কাজ করলে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ঝাড়ু তৈরি করা সম্ভব।
এলংগী পাড়ার ঝাড়ু তৈরির কারিগর বাবুল শেখ (৪০) জানান, খুব ছোট থেকেই ঝাড়ু তৈরির কাজ বেছে নিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, আমার বাবা এই কাজ করেছে, দাদা করেছে, শুনেছি তার দাদারাও এই এলাকায় ঝাড়ু বানাতো।
আরও পড়ুন: গরুর খুরা রোগে খুলনায় কমেছে দুধ উৎপাদন
‘ঝাড়ু বানানো একটা নিচু পেশা, সমাজে কেউ দাম দেয় না। শুধু বংশগত পেশা বলে মায়ায় পড়ে এই পেশা ছাড়তে পারিনি,’ বলেন তিনি।
কারিগর আতিয়ার শেখ (৫৫) বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকে এই কাজ করি। কিন্তু কোনোদিন সরকারি বা বেসরকারি কোনো লোক আমাদের খোঁজ নিতে আসেনি।’
আরও পড়ুন: বার্ধক্যে ধুঁকছে ভিক্টোরিয়া কলেজের কলা ভবন
মাজেদা খাতুন বলেন, ‘ঘরের কাজের পাশাপাশি ঝাড়ু তৈরি করি। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করি। সরকারি- বেসরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়ায় আয় কম হওয়ায় অভাবের কারণে দিনদিন মানুষ ঝাড়ু বানানো বাদ দিয়ে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।’
কারিগর করিম শেখ বলেন, ‘আমরা অনেকেই নিজেদের পুঁজি না থাকায় এনজিও থেকে কিস্তি উঠিয়ে ছনখড় কিনে রাখি। এতে খরচ বেশি হয়। আমাদের কোনো স্বীকৃতি না থাকায় ব্যাংক লোন দেয় না। করোনার মধ্যেও আমরা কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’
কুষ্টিয়া (ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প সংস্থা) বিসিকের ডিজি সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি এলংগী এলাকায় প্রায় শতবছর ধরে শতাধিক পরিবার ঝাড়ু তৈরি করে। এটা একটা কুঠির শিল্প হলেও কুষ্টিয়ার এই শিল্পের কোনো স্বীকৃতি এখনো দেয়া হয়নি। ’
আরও পড়ুন: ভিক্ষা নয়, কাজ করেই জীবন বদলাতে চান প্রতিবন্ধী রহিম
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে এলংগী এলাকা পরিদর্শন করেছি। প্রথমে তাদের কাজের স্বীকৃতি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে।’