বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে, মুখে মাস্ক পরার কোনো খারাপ দিক নেই। উল্টো তাদের আশঙ্কা, মাস্ক পরিধানের ব্যাপারে মানুষের উদাসীনতা আসন্ন শীতে করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে মাস্ক পরে থাকা অস্বস্তিকর, এতে ত্বকে চুলকায়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, অক্সিজেনের ঘাটতি বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় বলে ব্যবহারকারীরা যুক্তি দেখালেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাস্ক পরার অসুবিধা নেই বললেই চলে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রুখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর উপায়। কেননা উপসর্গহীন অনেক রোগী অসচেতনভাবে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মহামারি করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকেও জনসমাগম স্থলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি মাস্ক পরিধানের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার মাস্ক ব্যবহার করা উচিত... মাস্ক পরিধান না করে আসন্ন দুর্গাপূজাসহ প্রকাশ্য স্থান, সমাবেশ, মসজিদ এবং অন্যান্য উৎসবগুলোতে যাওয়া উচিত নয়। সবাই মাস্ক ব্যবহার করলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে।
যেভোবে মাস্ক ব্যবহার করবেন
ইউএনবির সাথে আলাপকালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে মাস্ক ব্যবহার করা দরকার। তবে সবসময় এটা পরে থাকতে হবে না।
তিনি বলেন, ‘কখন ও কীভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে তা আমাদের জানা উচিত। মাস্ক ব্যবহারের খুব কম অসুবিধা আছে। যদি কার্যকরভাবে মাস্ক ব্যবহার করতে জানি তবে সেগুলোও আমরা কমিয়ে আনতে পারবো।’
‘করোনা আক্রান্ত রোগীকে অন্যের সংস্পর্শে যেতে হলে কেবল তখনই মুখে মাস্ক পরা উচিত। যখন তিনি আইসোলেশনে থাকবেন এবং কারও কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা নেই তখন তাকে মাস্ক পরতে হবে না।’
একইসাথে এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা বা পরিবারের সদস্যরা যখন কোনো করোনার আক্রান্ত রোগীকে দেখতে যাবেন তখন তাকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বাসায় কোনও করোনার রোগী না থাকলে বাড়িতে কারো মাস্ক ব্যবহার করার দরকার নেই। ঘরের বাইরে গেলে এবং সেখানে অন্যান্য মানুষের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তখন মাস্ক পরা উচিত। কোনো মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে সাথে সাথে মাস্ক খুলে রাখা উচিত। আপনি যখন বাড়ি বা অফিসের বাইরে একা থাকেন, তখনও মাস্ক খুলে ফেলতে পারেন। এমনকি আপনি অফিসে থাককালীন এবং আপনার আশপাশে কেউ না থাকলে তখনও আপনি মাস্ক ছাড়াই কাজ করতে পারেন।
তবে বাসে, ট্রেনে বা অন্যান্য যানবাহনে যাতায়াতের সময় মানুষের অবশ্যই মাস্ক পরা দরকার, বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহারের সঠিক নিয়ম না জানার কারণে অনেকের মধ্যেই দীর্ঘ সময় ধরে এ সুরক্ষা সামগ্রীটি ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। তাদের এ অভ্যাসটি পরিবর্তন করা উচিত। বিশেষত যাদের শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের সমস্যা আছে তাদের নিয়মিত বিরতিতে নিরাপদ ও বিচ্ছিন্ন জায়গায় গিয়ে মাস্ক খুলে রাখা উচিত।
মাস্ক ব্যবহার অস্বস্থি তৈরি করে কেন?
অনেকে বলে মাস্ক ব্যবহারে মাথা ব্যথা, ত্বকে জ্বালাত্বন করা, অক্সিজেনের ঘাটতিসহ আরও বেশ কিছু সমস্যা তৈরি করে, যদিও এর স্বপক্ষে পর্যাপ্ত কোনো প্রমাণ নেই, উল্লেখ করেন ডা. মোজাহেরুল।
তিনি বলেন, ‘শারীরবৃত্তীয় কারণে অনেকে জ্বালাতন ও অস্বস্তি বোধ করে থাকেন। তাদের এমন মাস্ক পরা উচিত যা পরলে তারা আরাম পাবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু মানুষ এন-৯৫ বা এর সমতুল্য মাস্ক পরতে পছন্দ করেন আবার অনেকের জন্য এটি অস্বস্তিকর। যাদের অস্বস্থি হবে তাদের সার্জিকেল বা কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।’
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করেন ও মোটা মাস্ক দীর্ঘ সময় ধরে পরে থাকেন তাদের জন্য মাস্ক কিছুটা অস্বস্থির কারণ হতে পারে।
তিনি বলেন, অস্বস্তি বোধ করলে নিরাপদ স্থানে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য মাস্ক সরিয়ে রাখার মাধ্যমে তার এ সমস্যার সমাধান পেতে পারেন।
স্বাচিপ সভাপতি বলেন, সাধারণত, স্বাস্থ্যকর্মীরা মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী যেমন গ্লাভস, গগলস এবং পিপিই পরে দীর্ঘ সময় ধরে কর্মস্থলে থাকেন। এতে যদি তারা অভ্যস্ত না হতে পারেন তবে তাদের শুধু মাস্ক পরে গেলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা না। মাস্ক সম্পর্কে যে সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করা হচ্ছে এর বেশিরভাগই হলো মানসিক।
ইকবাল বলেন, ‘সাধারণ মানুষের খুব মোটা ও এন -৯৫ বা সমমানের মাস্ক ব্যবহার করা দরকার নেই কেননা তারা চিকিৎসক ও নার্সদের মতো উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন না। সাধারণদের মার্জিকেল বা কাপড়ের তৈরি দুই বা বা তিনস্তরের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।’
বাড়িতে কাপড় দিয়ে মাস্ক তৈরি করে সেগুলো ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ ধরণের মাস্ক সাধারণ মানুষের জন্য খুবই উপকারী কারণ তারা নিয়মিত এগুলো ধুতে পারেন। এতে অর্থের অপচয়ও কমে যাবে।’
মাস্ক ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. ইকবাল বলেন, ‘দেশে যেহেতু অনেক উপসর্গহীন করোনা রোগী আছেন, মাস্ক এ জাতীয় রোগীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। পাশাপাশি এটি সংক্রামিতদের থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াও রোধ করতেও সহায়তা করে।’
তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহার মানুষকে বাতাস মিশে থাকা ধুলো, ধূলিকণা এবং অন্যান্য দূষিত উপাদান নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে যেতে বাধা দেয়।
ইকবাল বরেন, ‘ধুলো দূষণের কারণে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তাই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করলে মানুষ ধূলিকণা, বায়ু এবং পরিবেশ দূষণের কারণে হওয়া অনেক রোগ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন।
তিনি বলেন, জাপানি লোকেরা সাধারণত যখনই বাড়ির বাইরে যায় তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা মাস্ক ব্যবহার করেন। তাদের মাস্ক ব্যবহারে কোনো সমস্যাই হয় না কারণ তারা এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। করোনা চলে গেলেও আমাদের মাস্ক ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করা উচিত।
মাস্ক ব্যবহারের কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কারো কাছাকাছি যাওয়ার সময় বা অন্য ব্যক্তির সংস্পর্শে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহারে বড় কোনো অসুবিধা নেই। তবে এখনো মাস্ক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে না উঠার কারণে মানুষের দীর্ঘ সময় ধরে মাস্ক ব্যবহারে অস্বস্তি বোধ করতে পারেন।
ডা. আতিক বলেন, যতই শীত ঘনিয়ে আসছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে শতভাগ মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করা জরুরি।
বিএসএমএমইউয়ের এ অধ্যাপক বলেন, ‘বিশেষত, বয়স্ক ব্যক্তি ও যাদের কমরেবিডিটিস আছে, শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে ও শিশুদের মাস্ক ছাড়াই বাইরে যাওয়া উচিত নয়। মাস্ক ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে আমাদেরকে মিডিয়ার মাধ্যমে এ বার্তা দেয়া উচিত যে মাস্ক ব্যবহারে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।