দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ নামেও পরিচিত প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘হালদা নদী’ বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।
এই হালদায় বসবাসকারী গাঙ্গেয় ডলফিন (প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা) বাংলাদেশের একটি বিপন্ন প্রজাতির স্বাদু পানির স্তন্যপায়ী প্রাণি। হালদা নদীকে ডলফিনের ‘অভয়াশ্রম’ হিসেবেই ধরা হয়। অথচ এই অভয়াশ্রমই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে ডলফিনের জন্য। পাঁচ বছর ধরে এই নদীতে প্রাণ হারাচ্ছে মিঠাপানির অতি বিপন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীটি।
স্থানীয় ভাষায় উতোম কিংবা শুশুক নামে পরিচিত মিঠাপানির এই প্রাণী হচ্ছে গাঙ্গেস বা গাঙ্গেয় ডলফিন। সাধারণত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে গাঙ্গেয় ডলফিনের বিচরণ। কিন্তু মানবসৃষ্ঠ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের প্রভাবে হালদার জলজ পরিবেশ ডলফিনের জন্য ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে উঠছে যা পরিবেশ ও হালদা জন্য সামগ্রিক অশনিসংকেত বলে মনে করছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট সাত প্রজাতির ডলফিন পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রধান গাঙ্গেয় ডলফিন। তবে দেশে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে আইইউসিএনের লাল তালিকাভুক্ত এটি। স্তন্যপায়ী এই প্রাণীটি সাধারণত দেশীয় মিঠা পানির নদীতে পাওয়া যায়।
হালদা বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভূক্ত (অতি বিপন্ন প্রজাতি) জলজ প্রাণী হলো ডলফিন। বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে বিপন্ন প্রজাতির ডলফিন আছে মাত্র এক হাজার ১০০টি। এর মধ্যে শুধু হালদাতেই ছিল ১৭০টি। গত চার বছরে হালদায় ৩৯টি ডলফিন মারা গেছে। এর মধ্যে চলতি বছরে প্রাপ্ত মৃত ডলফিনের সংখ্যা ৬ টি। এরমধ্যে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত তিনটি উদ্বার করা হয়েছিল গত জুলাই মাসে।
আরও পড়ুন: ফেনীর অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের এক্স-রে মেশিন বছরের পর বছর ধরে বাক্সবন্দী
সর্বশেষ মৃত ডলফিনটি (৩৯ তম) উদ্ধার করা হয়েছে গত ৩রা নভেম্বর-২০২২। হাটহাজারীর পুরাতন হালদা নদীর দক্ষিণ বাড়িঘোনা উত্তর মসজিদের পাশে খালের ধারে আটকে ছিল। উদ্ধার করা ডলফিনটির শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে যাওয়ায় মৃত্যুর কারণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। একের পর এক এ জলজ প্রাণীর মৃত্যু হলেও যেন দেখার কেউ নেই।
হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলামের মতে প্রতিনিয়ত হালদা নদী ও এর শাখাখালের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের জাল,বঁড়শি ও বিষ ব্যবহার করে অবৈধভাবে মাছ ধরা হচ্ছে। এসব অবৈধজাল হালদায় ডলফিন মৃত্যুর অন্যতম কারণ। পাশাপাশি ডলফিনের বয়সবৃদ্ধি, খাদ্যের অভাব, দুষণ, পানির গুণাবলি পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি সম্পৃক্ত। হালদার বাস্ততন্তুকে ডলফিনের নিরাপদ আবাসস্থল করতে প্রশাসনের পাশাপাশি হালদা সম্পৃক্ত সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সূত্র জানা গেছে, নৌযানের প্রপেলার, বালু–পাথর পরিবহনের ইঞ্জিনচালিত নৌকা–বাল্কহেড ও বালু তোলার যন্ত্র ড্রেজারের আঘাত, দূষণ, লবণাক্ততা এবং জালে আটকে ডলফিন মারা যাচ্ছে।
তারা জানায়, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৯টি ডলফিন মারা গেছে।