পাকিস্তানে কথিত কোরআন অবমাননার অভিযোগে ক্ষুব্ধ জনতা কয়েকটি গির্জা এবং সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের বেশকিছু বাড়িতে হামলা চালানের ঘটনায় ১২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পবিত্র গ্রন্থ কোরআন অবমাননা করার অভিযোগে পুলিশ দুই খ্রিস্টান পুরুষকেও গ্রেপ্তার করেছে।
বৃহস্পতিবার দেশটির কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
কোরআন অবমাননার অভিযোগে গত বুধবার(১৬ আগস্ট) দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের জরানওয়ালা জেলায় তাণ্ডব শুরু করেছিল উত্তেজিত জনতা। যার ফলে খ্রিস্টানরা নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কারণ জনতা খ্রিস্টানদের উপর দেশের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ শুরু করেছিল।
নগরীর পুলিশ প্রধান, বিলাল মেহমুদ বলেছেন, অফিসাররা রাজা আমির এবং তার এক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে। স্থানীয় মুসলমানরা যাদেরকে কুরআনের একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা ও অন্য পৃষ্ঠাগুলোতে অবমাননাকর মন্তব্য লিখে এবং গ্রন্থটি মাটিতে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল।
আঞ্চলিক পুলিশ প্রধান রিজওয়ান খান বলেছেন, সন্দেহভাজন দাঙ্গাবাজ হিসাবে ১২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কর্তৃপক্ষ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সৈন্যদের মোতায়েন করে এবং খ্রিস্টান বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার ধ্বংস দেখতে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে আসে।
শাজিয়া আমজাদ তার পোড়া বাড়ির বাইরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমরা বাড়িতে বসা থাকতে হঠাৎ শুনতে পেলাম যে জনতার একটি দল আসছে এবং তারা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং গীর্জায় হামলা করছে।’
তিনি বলেছিলেন, জনতা ঘরের জিনিসপত্র এবং আসবাবপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তার কিছু জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে। সে তার পরিবারের সঙ্গে নিরাপদ এলাকায় অবস্থান করছিলেন।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর শপথ
অন্যান্য খ্রিস্টানরাও অনুরূপ কঠিন পরিস্থিতির বর্ণনা করেছিল এবং বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।
আজিম মসিহ তার বাড়ির বাইরে বসে বসে কাঁদছিলেন। যেটি তার রাস্তায় পুড়ে ফেলা কয়েকটি ভবনের মধ্যে একটি ছিল। তিনি বলেন, কিছু দাঙ্গাকারী আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়ার পর খ্রিস্টানদের গৃহস্থালির জিনিসপত্র নিতে গাড়ি নিয়ে আসে।
তিনি বলেন,‘কেন তারা আমাদের সঙ্গে এটা করল? আমরা কোনো অন্যায় করিনি।’
স্থানীয় পুরোহিত খালিদ মুখতার বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, জরানওয়ালার ১৭টি গির্জার বেশিরভাগেই আক্রমণ করা হয়েছে এবং তার নিজের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত গীর্জা এবং বাড়িগুলো এক সপ্তাহের মধ্যে মেরামত করা হবে এবং যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
সারাদেশে সহিংসতাটির নিন্দা জানানো হয়েছে। দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল-উল-হক কাকার।
আঞ্চলিক পুলিশ প্রধান বলেছেন, জনতা দ্রুত জড়ো হয়ে গীর্জা ও খ্রিস্টানদের বাড়িতে হামলা শুরু করে। দাঙ্গাকারীরা শহরের প্রশাসকের অফিসেও হামলা চালায়, কিন্তু পুলিশ হস্তক্ষেপ করে, ফাঁকা গুলি ছুড়ে এবং মুসলিম আলেম ও মুরব্বিদের সহায়তায় হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিও এবং ফটোতে দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ জনতা একটি গির্জার ওপর উঠেছে, ইটের টুকরো দিয়ে ঢিল ছুঁড়ছে এবং আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা যায় আরও চারটি গির্জায় হামলা করা হয়, আক্রমণকারীরা জানালা ভেঙে আসবাবের টুকরো বাইরে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেন।
অন্য একটি ভিডিওতে, একজন ব্যক্তিকে একটি গির্জার ছাদে উঠে হাতুড়ি দিয়ে বার বার আঘাত করে একটি স্টিলের ক্রস সরাতে দেখা যায়, আর তাকে বাহবা দিচ্ছে জড়ো হওয়া লোকজন।
আরও পড়ুন: 'শান্তি ও স্থিতাবস্থা' বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি চীন-ভারতের
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ওই সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে।
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনের অধীনে, যে কেউ ইসলাম বা ইসলামিক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের অবমাননার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। যদিও কর্তৃপক্ষ এখনও ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারেনি। প্রায়শই শুধুমাত্র একটি অভিযোগ জনতাকে সহিংসতা, বিচারহীনতা এবং হত্যার জন্য উস্কে দিতে পারে।
অধিকার গ্রুপগুলো বলছে, ব্লাসফেমির অভিযোগগুলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভয় দেখানো এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল পাকিস্তানকে পূর্ণ তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বুধবার ওয়াশিংটনে তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রত্যেকের জন্য ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করি।’
আরও পড়ুন: কোরআন অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানে খ্রিস্টানদের গির্জায় হামলা