তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পে ভেঙে পড়া হাজার হাজার ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিতদের খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে উদ্ধারকারী দল। তবে উদ্ধার কার্যক্রম চলবে বলে জানিয়েছে তারা।
এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পে বুধবার মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে।
দুর্যোগ কবলিত অঞ্চলে আরও সাহায্য পাঠানোর জন্য তুর্কি সরকারের প্রতি আহ্বানের মধ্যে, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান কাহরামানমারাসে একটি ‘তাঁবুর শহর’ পরিদর্শন করেছেন। মানুষ বাধ্য হয়ে সেখানে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে তাবুতে বসবাস করছে।
তিনি প্রতিক্রিয়ার প্রথম দিকে ঘাটতি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কাউকে ‘রাস্তায় পড়ে থাকতে দেয়া হবে না।’
দুই ডজনেরও বেশি দেশের উদ্ধারকারী দল হাজার হাজার স্থানীয় জরুরী কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এসেছে। কিন্তু সাত দশমিক আট মাত্রার ভূমিকম্প এবং এর শক্তিশালী আফটারশকগুলো থেকে ধ্বংসের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যেখানে অনেকেই এখনও সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছেন৷
আরও পড়ুন: তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প: ৯০০০ জনের বেশি নিহত
প্রাক্তন সাংবাদিক ওজেল পিকাল জানায়, তুরস্কের শহর মালতয়াতে উদ্ধার করা লাশগুলোকে মাটিতে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল। কম্বলে আবৃত ছিল, যখন উদ্ধারকারীরা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন কিংবা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য যানবাহনের আসার অপেক্ষা করছিলেন। এসময় তিনি ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি লাশ উদ্ধার করার দৃশ্যও দেখেছিলেন।
পিকাল নিজেও উদ্ধার প্রচেষ্টায় অংশ নিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তাপমাত্রা মাইনাস ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস (২১ ফারেনহাইট) এ নেমে যাওয়ায় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মানুষ ঠান্ডায়ও মারা যেতে পারে।
পিকাল টেলিফোনে এপিকে বলেন, ‘আজকের দিনটি সুখকর নয়, কারণ আজ পর্যন্ত মালত্যায় কোনো আশা নেই।’ ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ জীবিত বের হচ্ছে না।
পিকাল বলেন, শহরে একটি হোটেল ভবন ধসে পড়েছে, যেখানে শতাধিক লোক আটকে থাকতে পারে।
তিনি জানান, যে এলাকায় তিনি ছিলেন সেখানে উদ্ধারকারীদের ঘাটতি ছিল এবং ঠান্ডা স্বেচ্ছাসেবক ও সরকারি দলের উদ্ধার প্রচেষ্টা কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই অঞ্চলে
রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলাফেরা ও প্রবেশাধিকারও ব্যাহত হয়েছে।
পিকাল বলেন, ‘ঠান্ডার কারণে আমাদের হাত কিছুই তুলতে পারে না। কাজের জন্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।’
সিরিয়ায় এক দশকেরও বেশি গৃহযুদ্ধের কারণে একটি অঞ্চলে দুর্ভোগের মাত্রা খুবই বেশি ছিল। যুদ্ধের কারণে দেশের অভ্যন্তরে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেক মানুষ তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ায় ধ্বংসস্তূপের নিচে কত মানুষ আটকা পড়ে থাকতে পারে তা স্পষ্ট নয়।
তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, দেশটিতে মৃতের সংখ্যা সাড়ে আট হাজার পেরিয়েছে।
হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন জানায়, সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে যে সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মৃতের সংখ্যা এক হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে এবং বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কমপক্ষে এক হাজার ৪০০ জন মারা গেছে।
সোমবারের ভূমিকম্প এবং একাধিক শক্তিশালী আফটারশকের পর নিহতের মোট সংখ্যা ১১ হাজারে পৌঁছেছে। আহত হওয়ার সংখ্যা আরও কয়েক হাজার।
জাপানের কাছে ২০১১ সালে উৎপত্তি হওয়া একটি ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামিতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। তুরস্ক বা সিরিয়া এখনও নিখোঁজদের সংখ্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ না করলেও ‘বিধ্বংসী’ ভূমিকম্পের পরে পোপ ফ্রান্সিস তার সাপ্তাহিক সাধারণ শ্রোতাদের প্রার্থনা এবং সংহতি প্রদর্শনের জন্য বলেছেন।
আরও পড়ুন: তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃত্যু বেড়ে ৬৪০
সিরিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, তুরস্কে ভূমিকম্পের সময় মারা যাওয়া ১০০ জনেরও বেশি সিরীয়দের লাশ বাব আল-হাওয়া সীমান্ত দিয়ে দাফনের জন্য দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
সীমান্তের সিরীয় অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা মাজেন আলুশ বলেছেন, আরও ২০টি লাশ সীমান্তে তাদের পথে রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, তারা সবাই সিরিয়ান শরণার্থী যারা যুদ্ধকালীন দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
এখনও আটকে পড়াদের জন্য উদ্বেগ বাড়ছে, তুরস্কে উদ্ধারকারী টিম পোলিশ জানায়, তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন পর্যন্ত ৯ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে, যার মধ্যে দুই সন্তানের বাবা-মা এবং ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে।
ভূমিকম্পের প্রায় দুই দিন পর উদ্ধারকারীরা ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কেন্দ্র কাহরামানমারাসের একটি ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্টের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তিন বছর বয়সী ছেলে আরিফ কানকে উদ্ধার করে।
ছেলেটির শরীরের নীচের অংশ কংক্রিটের স্ল্যাব এবং পেঁচানো রডে আটকে থাকার কারণে ঠান্ডা থেকে রক্ষায় জরুরি কর্মীরা তার ওপর একটি কম্বল দিয়ে দেয়। কারণ আরেকটি ধসের আশঙ্কা মাথায় রেখে তারা সাবধানে তার কাছ থেকে ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলে।
ছেলেটির বাবা এরতুগ্রুল কিসিকে আগেই উদ্ধার করা হয়েছিল। যখন তার ছেলেকে উদ্ধার করে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছিল তখন তিনি কাঁদছিলেন।
তুর্কি টেলিভিশনে দেশে নাটকীয় উদ্ধারের ঘটনাটি সম্প্রচারের সময় একজন সাংবাদিক ঘোষণা করেছিলেন যে ‘আপাতত কাহরামানমারাসে আশার নাম আরিফ কান।’
কয়েক ঘন্টা পরে আদিয়ামান শহরে তার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকারীরা ১০ বছর বয়সী বেতুল এদিসকে উদ্ধার করে। এসময় উপস্থিতরা করতালির দেয় এবং তার দাদা তাকে চুম্বন করেছিলেন। তাকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে নেয়ার সময় তার সঙ্গে আদর করে কথা বলেছিলেন।
সোমবার বিকালে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার একটি শহরে, বাসিন্দারা একটি কান্নারত নবজাতককে তার মৃত মায়ের সঙ্গে নাভির কর্ড দ্বারা সংযুক্ত দেখতে পান।
শিশুটির স্বজনরা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)কে জানিয়েছেন, ছোট্ট শহর জিন্ডারিসে একটি ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া শিশুটির পরিবারের বাকি সবাই মারা গেছে।
কিন্তু এই ধরনের গল্পগুলো ভূমিকম্পের দুই পরও ছিল। সোমবার ভোরের এই ভয়াবহ ভূমিকম্প একটি বিশাল এলাকাকে ধ্বংস করে দেয়। হাজার হাজার বিল্ডিং ধসে পড়ে। হিমশীতল তাপমাত্রা এবং চলমান আফটারশকগুলো উদ্ধার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তোলে।
তুরস্কে বেঁচে যাওয়া অনেককে গাড়িতে, বাইরে বা সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ঘুমাতে হয়েছে।
২৭ বছর বয়সী আয়সান কার্ট এপিকে বলেছেন, ‘আমাদের তাঁবু নেই, গরম করার চুলা নেই, আমাদের কিছু নেই। আমাদের বাচ্চাদের অবস্থা খারাপ। আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি এবং আমাদের বাচ্চারা ঠান্ডায় বাইরে আছে। আমরা ক্ষুধা বা ভূমিকম্পে মারা যাইনি, তবে আমরা ঠান্ডায় জমে মরব।’
আরও পড়ুন: তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃত্যু বেড়ে ৬৪০
সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধ এবং রাশিয়া-সমর্থিত সরকারি বাহিনী বেষ্টিত সীমান্তে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে সহায়তা প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সিরিয়া নিজেই যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে একটি পরিত্যক্ত এলাকা।
অঞ্চলটি প্রধান ফল্ট লাইনের ওপরে থাকায় প্রায়শই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। ১৯৯৯ সালে উত্তর-পশ্চিম তুরস্কে অনুরূপ শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রায় ১৮ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।