করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল রাখতে ঋণ নয় মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে হবে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে অভিমত দেন আলোচকরা।
কানাডার টিভি মেট্রো মেইল (টিএমএম) আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে এ অভিমত দেন আলোচকরা।
আলোচকরা আরও বলেন, বৈশ্বিকভাবে করোনা মহামারি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোকে প্রভাবিত করছে। এ জন্যে আনুষ্ঠানিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক খাতকে গুরুত্ব দিয়ে করোনা সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
আরও পড়ুন: নিত্যপণ্যের দামে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না: ক্যাব
টিভি মেট্রো মেইল কানাডার নির্বাহী পরিচালক ইমামুল হকের পরিচালনায় আলোচনায় অংশ নেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন, এপেক্স ফুটওয়্যার এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যবসায়ী নাসিম মনজুর, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি'র (বেপজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম এবং জি টিভির প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজা।
'করোনাকালে বাংলাদেশের ব্যবস্যা-বাণিজ্য কেমন চলছে' শীর্ষক এক আলোচনায় বর্তমান মহামারির ফলে বিরাজমান সংকট ও আসন্ন সংকটের বিভিন্ন আঙ্গিক ও উত্তরণের উপায় নিয়ে বক্তারা কথা বলেন।
আরও পড়ুন: পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের দাবি ক্যাবের
টিএমএম এর চিটচ্যাট অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কোভিড-১৯ মহামারি বর্তমানে কতটুকু প্রভাব ফেলছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিনা বা দাঁড়ালেও নিকট ভবিষ্যতে এ অর্থনীতির চেহারা কেমন হবে, ভারত ও চীনের সাথে ঋণচুক্তি এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়।
অনুষ্ঠানে অর্থিনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে খুব একটা ভালো নেই বলে মনে করেন এবং বলেন, "উৎপাদনশীল কাজের কারণে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু তা কীভাবে হচ্ছে? তা কি অন্তর্ভুক্তিমূলক? প্রবৃদ্ধির গুণগত মান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। নিম্ন আয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই সময়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হচ্ছে, এর ফলে আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ পড়ছে।"
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা সামগ্রী দিলো প্রাণ-আরএফএল
করোনার প্রভাব বিষয়ে তিনি বলেন, গত বছরে মহামারির প্রথম পর্যায়ে আমাদের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত চাঙ্গা হয়ে উঠছিল, ঘুরে দাড়াচ্ছিল যখন অনেক বড় অর্থনীতিতে ও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে নাসিম মনজুর বলেন, মানুষের কর্মসংস্থান, আয়, দারিদ্র্য, অসাম্যের বিষয়টিকে এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিতে হবে। সংখ্যাগত প্রবৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য না রেখে অন্তর্ভুক্তির দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। প্রবৃদ্ধি ছাড়াও অন্যান্য সূচক, যা দেশের মানুষের প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরে, সেগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, "কর কতটা আদায় করতে পারল এমন অসুস্থ মানসিকতা থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বেরিয়ে আসতে হবে, তাদের বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। কর্মসংস্থান তৈরি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও তাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।"
তিনি আরও মনে করেন যে শিল্পের বহুমুখীকরণের উপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং রপ্তানি খাতের পণ্যে বর্তমানের বৈষম্যমূলক কর ব্যবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন।
মহামারিকালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বিষয়ে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম বলেন, "মহামারিকালেও বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, নতুন বিনিয়োগে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি আমরা। এমন বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতিকে করোনা পরবর্তীকালে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।"
বিশ্ব বিনিয়োগের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ যখন হ্ৰাস পেয়েছে ৪২% তখন বাংলাদেশে হ্রাস পেয়েছে মাত্র ১৯.৫%, এই বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো পর্যায়ে আছে।
সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বাংলাদেশ অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষি খাত, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, ও ব্যক্তি খাতের রেসিলিয়েন্স বা সহনশীলতার প্রশংসা করে বলেন, "কর কাঠামো যদি অতিমাত্রায় নিবর্তনমূলক হয় এবং ব্যবসায়ীদের গলায় চাপ দিয়ে যদি কর আদায়ের টার্গেট পূরণ করতে হয় তাহলে একসময় বড় ব্যবসায়ীরাও মুখ থুবড়ে পড়বে।"
চলতি আয় যখন কমাতে পারছে না সরকার তখন সরকার বিষয়ে তিনি বলেন, "আয়ের সাথে সঙ্গতি না রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।"
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টির সাথে সাথে সামাজিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টিকেও সমান্তরালভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "আমাদের সক্ষমতা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। অতিমারীর সময় সাধারণত বাজেটে ভর্তুকির পরামর্শ দেয়া হয়, কিন্তু আমরা দেখছি বরাদ্দকৃত বাজেটই আমরা খরচ করতে পারছি না। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মানুষের হাতে নগত অর্থ প্রয়োজন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ প্রয়োজন।"
করোনা পরবর্তীকালে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে নগদ প্রণোদনার পাশাপাশি অন্য বিকল্পগুলোও ভাবা প্রয়োজন বলে বক্তারা মনে করেন।