বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমাপ্তির পর প্রবাসী সরকার দেশে ফিরে এসেই রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাকে সামনে রেখেই গঠিত হয় গণপরিষদ যার কাজ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্বলিত সংবিধান প্রণয়ন করা। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তানের অংশের এমএনএ (মেম্বার অব নেশনাল এসেম্বলি) ও এমপিএ ( মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল এসেম্বলি) গণ এ গণপরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। এ পরিষদে অন্য দলের দু একজন ছাড়া বাকি সকলেই আওয়ামী লীগের। কারণ ৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত সকলেই ছিল আওয়ামী লীগের। সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধকালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। জাতীয় স্বার্থে অন্য সকল দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।
অবশেষে সংবিধান প্রণীত হলো। তার আলোকে ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা এলো।
স্বাধীন দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অটুট থাকবে এটাই সবার কাম্য ছিল। কিন্তু ১৯৭২ সালেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা অন্য কোনো দল সাহস না করলেও ছাত্রলীগের একাংশ তা করে। ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে মুখোমুখি দু’পক্ষ পৃথক সম্মেলনের আয়োজন করে এবং উভয় দলই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রচার চালায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বাধীন অংশের সম্মেলনে যোগ দেন। এ অংশ মুজিববাদী ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সমর্থন হারা অংশটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজ। তারা সরাসরি সরকারের সমালোচনায় লিপ্ত হয় যা ছিল সেসময়ে অকল্পনীয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। পাকিস্তানে এ দলটি ওয়ালী ন্যাপ নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলটি ওয়ালীর পরিবর্তে মোজাফফর নামে ব্রাকেটবন্দি হয়। তারা মস্কোপন্থী নামেও পরিচিত ছিল। এ দলটি স্বাধীনতাত্তোর সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে চলে। মূলত তারা ব্যস্ত ছিল মহান সোভিয়েত ইউনিয়নের গুন গান গাইতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ছাত্রবৃত্তি সহ সুযোগ সুবিধাগুলো তারাই বেশি ভোগ করে। অবশ্য লড়াকু মনোভাবের পরিবর্তে সোভিয়েতপন্থীরা সব সময়ই নৃত্য গীত ও রাস্তায় চিকা মারার মধ্যেই বিপ্লব খুঁজতেন যার উল্টোটা ছিল ছাত্রলীগ।
তৃতীয় অবস্থানে ছিল ভাসানীপন্থী তথা চীনপন্থী ন্যাপ। তবে এ দলটি বিপ্লবের মত ও পথ নিয়ে অনেক ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। মাওলানা ভাসানী অনেক জনপ্রিয় ছিলেন কিন্তু লোকসংখ্যা ও সমর্থক কম থাকায় দলটি শক্তিহীন ছিল। তবে মাওলানা ভাসানী স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন ও ভুখা মিছিল, হরতাল ইত্যাদি কর্মসূচি প্রদান করেন।
মোটামুটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে ন্যাপ মোজাফফর, ন্যাপ ভাসানী ও নব্য গঠিত জাসদের নাম উল্লেখ করা যায়।
সংবিধান পাস হওয়ার পর সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলে কে থাকবে কি ভূমিকা হবে তার ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে। এর মধ্যে ন্যাপ মোজাফফর হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম করে তোলে। ১৯৭৩ এর ১ জানুয়ারি ন্যাপ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো চিলির নিহত নেতা সালভাদর আলেন্দের সমর্থনে রাজধানীতে এক মিছিল বের করে। তারা পল্টনের মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে হামলা চালানোর চেষ্টা করে। পুলিশের গুলিতে মতিউল কাদের নিহত হয়। স্বাধীন দেশে নিজেদের পুলিশের গুলিতে প্রথম মৃত্যু। পুলিশের হস্তক্ষেপে আন্দোলন স্তিমিত হয়। এর পরই ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সারা দেশে মোজাফফর ন্যাপের অফিসগুলোতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা হামলা চালায়। স্থানে স্থানে অগ্নিসংযোগ ঘটে। অবশেষে ন্যাপের নেতাকর্মীরা হার্ড লাইন ছেড়ে আওয়ামী লীগকে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। একটা অলিখিত আপোষ হয়। তখন থেকেই ন্যাপ আওয়ামী লীগের বি টিম হিসাবে পরিচিত।
১৯৭৩ সালে নতুন সংবিধান অনুযায়ী দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রজাতন্ত্রের প্রথম নির্বাচনই কলংকিত, প্রার্থী হাইজ্যাক, বাক্স ছিনতাই, জালভোট, খুন খারাবি দিয়ে। জনগণের প্রত্যাশা মিটল না। বিসমিল্লায় গলদ রয়ে গেল যা ৫০ বছরেও ঠিক হলো না। পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। হাতে গোনা কয়েকজন বিরোধী দলীয় সদস্য। তিন শত আসনের মাঝে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা মাত্র ৭টি আসন লাভ করে যা দিয়ে বিরোধী দল গঠন করা সম্ভব নয়। শুরু থেকেই সরকার ও বিরোধীদলের কাধে কাধ মিলিয়ে যে গণতন্ত্রের সূচনা হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং বিরোধী দলকে রাস্তায় দাড়াতেই দেয়নি। বাংলাদেশের অবস্থাও তাই হলো। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে কাউকে কল্পনা করা যায়নি।
বিরোধী দল গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা পরিষ্কার। প্রথম জাতীয় সংসদে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ( মোজাফফর) যথাযথ বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। সরকারি দলের নেতারাও মাথা নিচু করে সরকারি দলকে সমর্থন দেয়ার কারণ ছিল সরকারের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সখ্যতা। কারণ বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও চীনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল বলেই রাশিয়া একমাত্র মিত্র ছিল।
চীনপন্থী ভাসানী ন্যাপ আদর্শ কিংবা অতি বিপ্লবী চরিত্রের কারণে কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়। তাই তারা সাংগঠনিকভাবে বিরোধী দল গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাছাড়া চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে থাকায় চীনপন্থী দলগুলো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে।
নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ( জাসদ) সংসদে দুজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল যা বিরোধী দল গঠনের সহায়ক ছিল না। এক সময় জাসদের দুর্দিন নেমে আসে। তারা পল্টনের জমায়েত থেকে ঘোষণা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাস ভবন ঘেরাও করে। পুলিশের গুলিতে আ স ম আব্দুর রবসহ অনেকে আহত হন। অনেকে গ্রেপ্তার হন। জাসদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
১৯৭৪ সালে বাকশাল গঠিত হলে বিরোধী দলের অংশ গ্রহণের সুযোগ ছিল না। খোদ আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়।
১৯৭৯ সালে পরবর্তী সংসদে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসে যার নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার আসাদুজ্জামান। আওয়ামীলীগের এক অংশ মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে ভিন্নমতের আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করে। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগ বিরোধী অবস্থানে থাকলেও জনসমর্থন ছিল না।
এরপর সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে মার্শাল ল জারি করে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেন। পুরনো দল ভেঙে মিজানুর রহমান চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, মওদুদ আহমেদ, কাজী জাফরের মত নেতারা এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। আতাউর রহমান খান তার দলীয় প্রতীক লাঙ্গল এরশাদ সাহেবের কাছে বিক্রয় করে দেন। এরশাদ সাহেবের আমলে নির্বাচন হয় এবং সংসদে জাতীয় পার্টি সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। আ স ম আব্দুর রব বিরোধী দলের নেতার পদ গ্রহণ করলেন। দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে গৃহপালিত বিরোধী দল শব্দটি সংযোজিত হলো
এরশাদের স্বৈরাচরী সরকারের পতন হলে নির্বাচিত সরকারের সূচনা হয়। এখানে গ্রহণযোগ্য একটা বিরোধী দল সচল থাকলেও তারা সংসদ বর্জন, আন্দোলন করে যা স্থিতিশীল একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সহায়ক হয়নি। পরবর্তী নির্বাচনে সরকারি ও বিরোধী দল তাদের স্থান অদল বদল করলেও উভয় পক্ষই তাদের চরিত্র পাল্টায়নি।
এরপর দেশে ওয়ান ইলেভেন আসে। দু বছর পর নির্বাচন হলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় যা দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। বিরোধী দলের কার্যক্রম আরও সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। সরকারি দল নির্ধারিত করে দেয় কে বা কারা সংসদ সদস্য হবে। বিরোধী দল গৃহপালিত রয়ে গেলো। সাথে যোগ হয় উচ্ছিষ্ট ভোগী নেতা সর্বস্ব দলের বিরোধী দলে অবস্থান। হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ইত্যাদি নেতারা সরকারি দল নির্ধারিত বিরোধী দলে সংসদে বসে। প্রহসনের নির্বাচনের পক্ষ নিয়ে এসব নেতারা দেশের জন্য কি অবদান রেখেছেন তা প্রশ্নবোধক হয়ে থাকল। চ্যালেঞ্জহীন সরকারি দল শত ভাগ লাভেও অপরিতৃপ্ত যা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন। এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদও একবার বলেছিলেন যে তিনি বিরোধী দল খুঁজে পান না।
প্রশ্ন থেকে যায় পঞ্চাশ বছরেও কোনো দল বিরোধী অবস্থানে শক্ত ভিত নিয়ে এগোতে পারেনি কেন? এর জন্য দায়ী রাজনৈতিকদের নীতিহীনতা ও অর্থ লোভ। এর নির্লজ্জ প্রকাশ ঘটেছে সরকারি দলের শক্তিতে টিকে থাকা বিরোধী নেতারা যখন সরকার বিরোধী বক্তব্য দেন ও হুমকি ধামকি দেন। এটা খুবই ব্যাঙ্গাত্মক বিষয়।
বিরোধী দল দাড়াতে না দেয়ায় সরকারের দোষ খুঁজে লাভ নেই। কারণ ক্ষমতা যেখানে হাতের তালুয় সেটা অন্য কারও হাতে যেতে দেয়া বোকামি। স্যাক্রিফাইস শব্দটা দেশের রাজনীতিতে আর নেই। নেতারা ক্ষমতা কুক্ষিগত, আকড়ে রাখাকে নীতি হিসেবে ধারণ ও লালন করে আসছে। ভবিষ্যৎ এর জন্য ভালো কিছু স্থায়ী করার চিন্তাও মাথায় রাখেননি।
দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনের কথা প্রথম থেকেই ভাবা উচিত ছিল। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক খোলাখুলিভাবেই বলেছিলেন বিরোধী দলের জন্য কিছু সিট ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে সচল রাখতে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নীতির কথাও উল্লেখ করেছিলেন। সে উপদেশ বিবেচনায় এনে যদি তা কার্যকর হতো তাহলে আজ সংসদ নেতার অন্ধকারে বিরোধী দলের অস্তিত্ব হাতড়াতে হতো না। সরকারি দলের অবস্থান হতো গৌরবের।
লেখক: কলামিস্ট কর্নেল (অব.) মো. শাহ জাহান মোল্লা
(প্রকাশিত মতামতের দায় লেখকের, ইউএনবির নয়)
পড়ুন: গণতন্ত্রের মোহমুক্তি