অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ওপর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ সংবিধান ও মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ, তাই এর সময়সীমা নির্দিষ্ট করতে হবে।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নরসিংদীর আতাউর রহমান ওরফে সুইডেন আতাউর রহমানের করা এক রিট আবেদনে জারি করা রুলের রায়ে এমন অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রবিবার এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
অন্যদিকে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেছে দুদক।
এর আগে ১৬ মার্চ দুদকের দেয়া নিষেধাজ্ঞার চিঠি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আরও পড়ুন:হত্যাচেষ্টা মামলায় ইরফান সেলিমকে কেন জামিন দেয়া হবে না: হাইকোর্ট
রবিবার প্রকাশিত রায়ে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আদালতের অভিমত হলো‘এই যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত করার প্রয়োজন হলে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধি প্রণয়ন এখন সময়ের বাস্তবতা; এবং ওই আইন বা বিধিতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশত্যাগে বারিত করার কারণ জানানো, গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির বক্তব্য/আপত্তি প্রদানের সুযোগ রাখতে হবে।’
‘অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারোর ওপর এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ সংবিধান ও মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ, তাই এর সময়সীমা নির্দিষ্ট করাও ন্যায়সংগত হবে। আমরা ইতোমধ্যে বিধিমালার বিধি ১৮ আলোচনা করেছি, যেখানে অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে অপরাধলব্ধ বা অবৈধ সম্পত্তি অবরুদ্ধ বা ক্রোক করার বিধান আছে। যদি অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে অপরাধলব্ধ বা অবৈধ সম্পত্তি অবরুদ্ধ বা ক্রোক করার বিধান থাকে সে ক্ষেত্রে একই যুক্তিতে অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশত্যাগে বারিত করার সুনির্দিষ্ট বিধি বা আইন প্রণয়নে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। ’
আরও পড়ুন: দুদক গত ৫ মাসে কতজনকে অব্যাহতি দিল তালিকা চাইলেন হাইকোর্ট
‘সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আদালতের সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অভিমত এই যে, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে যে, অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে যে কোন অপরাধের সাথে জড়িত সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত করার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন করা এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের আইন বা বিধি প্রণয়ন করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তবর্তী ব্যবস্থা হিসেবে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতের নিকট এ ধরনের বারিত আদেশ প্রার্থনা করা এবং আদালতের অনুমতি গ্রহণ করা।’
অভিমতে আদালত আরও বলেন, যথাযথ আইন বা বিধি প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত অত্র রায়ের নির্দেশনা ও অভিমতের আলোকে অভিযোগের অনুসন্ধান কিংবা মামলার তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা/কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেশ ত্যাগের বিষয়ে যথাযথ আদেশ প্রদানে সম্পূর্ণ এখতিয়ারবান হবে।
আরও পড়ুন: সিসিকে ১০ মাসে তালাকের আবেদন বেড়েছে ৮ গুণ
অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রতিনিধির মাধ্যমে এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে আবেদন জানালে আদালত সন্তুষ্টি সাপেক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যার মেয়াদ ৬০ দিনের অধিক হবে না বারিত আদেশ কিংবা স্বীয় বিবেচনায় ন্যায় সংগত অন্য কোনো আদেশ প্রদান করতে পারবে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ ওই আদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন জানাতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এবং নথিপত্র যদি দাখিল করা হয় পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করতে পারবে। বারিত আদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা/কর্তৃপক্ষ পুনরায় সংশ্লিষ্ট আদালতে আবেদন করতে পারবে এবং আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ যদি নথিপত্র দাখিল করে তা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ আদেশ দিবেন বলে রায়ে উল্লেখ করেন উচ্চ আদালত।
রায়ে উচ্চ আদালত আরও বলেন, আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৬ এ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার (ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশেন অব হিউম্যান রাইটস) অনুচ্ছেদ-১৩ এর প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা যা তার জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত তাতে হস্তক্ষেপ করা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। কোনো নাগরিকের চলাফেরা তথা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হলে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুনির্দিষ্ট কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই জানাতে হবে, যাতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান।
সরকার কিংবা রাষ্ট্রের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা শুধুমাত্র ‘সৌখিন’ বা ‘খেয়ালি ইচ্ছার’ বশবর্তী হয়ে দেশের কোনো নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে বা নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না উল্লেখ করে আদালত বলেন, একজন নাগরিকের চলাফেরার স্বাধীনতা ব্যক্তিজীবনের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, যা শাশ্বত। এ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে হলে আইন নির্ধারিত নিয়মে বা পদ্ধতিতে করতে হবে; অর্থাৎ কোনো নাগরিকের চলাফেরার মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করতে হলে তা করতে হবে আইন বা বিধি অনুসারে, জনস্বার্থে। যার বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার অধিকার রয়েছে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কারণসমূহ জানার।
‘আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, নাগরিকের চলাফেরার সাংবিধানিক অধিকার কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ বা বারিত করা অসাংবিধানিক। ’
দুর্নীতি ও অর্থপাচার মামলার তদন্তের বিষয়ে আদালত বলেন,এটা বাস্তবতা যে, দুর্নীতি কিংবা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলাসমূহ অনুসন্ধান বা তদন্ত কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, যদিও বা সংশ্লিষ্ট বিধিতে অনুসন্ধান বা তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। আমাদের বিচারিক অভিজ্ঞতা বলে যে, কমিশন কিংবা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা/কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসন্ধান বা তদন্ত কার্যক্রম আইন বা বিধিতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারে না।
‘এটাও বাস্তবতা যে,অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত অনেকে বিভিন্ন অজুহাতে দেশত্যাগ করছে এবং পরবর্তীতে তাদের আর আইন-আদালতের সম্মুখীন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সকল বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে দুর্নীতি বা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলায় কিংবা অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে দেশত্যাগে বারিত বা তার চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বা বিধি প্রণয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, যা সময়ের চাহিদাও বটে। সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধির অনুপস্থিতিতে কোনো তদন্ত সংস্থার দাপ্তরিক আদেশ দিয়ে এ ধরনের পদক্ষেপ বা কার্যধারা গ্রহণ সংবিধান পরিপন্থি। ’
২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আতাউর রহমানের সম্পদের তথ্য চেয়ে নোটিশ দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন। এ নোটিশের পর ২২ অক্টোবর তিনি তার সম্পদের তথ্য দুদকে দাখিল করেন। এরপর দুদক অনুসন্ধানে নামে। এ অনুসন্ধানকালে দুদক গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আতাউর রহমানের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেয়। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন আতাউর রহমান।